মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করে লাভের আশায়। লাভের পাশাপাশি তারা অর্থের নিরাপত্তার কথাও বিবেচনা করে থাকে। তাই মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে পছন্দ করে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক গুলোর বেহাল অবস্থার কারণে মানুষ তাদের অর্থ কোন ব্যাংকে জমা রাখবে তা নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কেউ এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রাখছে। আবার কেউ টাকা তুলে নিজের কাছে রাখছে। কিছু ব্যাংক থেকে গ্রাহকেরা আমানত ফেরত না পাওয়ায় মানুষের এমন আচরণ দেখা যাচ্ছে। আরও দেখুনঃ দেউলিয়া ব্যাংক তালিকা ২০২৩
দেশের ব্যাংক খাতের এমন পরিস্থিতে আপনি কোন ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করবেন তা নির্ণয় করা কষ্টসাধ্য কাজ। আমরা সাধারণত বেশি সুদের আশায় এফডিআর করে থাকি। কিন্তু আমাদের বেশি সুদের পাশাপাশি অর্থের নিরাপত্তার দিকও খেয়াল রাখতে হবে।তাই ফিক্সড ডিপোজিট করার জন্য কোন ব্যাংক সবচেয়ে ভাল বা কোন ব্যাংকে এফডিআর করলে আপনি বেশি সুদ পাবেন ও আমানত সুরক্ষিত থাকবে তা নিয়েই আমরা আজ আলোচনা করব।
ফিক্সড ডিপোজিট করার জন্য কোন ব্যাংক সবচেয়ে ভাল
ফিক্সড ডিপোজিট কি?
ফিক্সড ডিপোজিট করার আগে আপনাদের এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। সবার আগে জানতে হবে ফিক্সড ডিপোজিট কি। একটি নিদিষ্ট সময়ের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা রাখাকে ফিক্সড ডিপোজিট বলে। আর এই আমানতের বিপরীতে ব্যাংক যে সুদ দেয় তাকে এফডিআর বলে। টাকা জমা রাখার সময়সীমা হলো সর্বনিম্ন ৩ মাস থেকে সর্বচ্চো ৩ বছর। অন্যান্য আমানতের তুলনায় এই আমানতের সুদের হার বেশি থাকায় মানুষ এই আমানতে টাকা জমা রাখতে পছন্দ করে। আরও দেখুনঃ আজকের বাজার দর ২০২৩
ফিক্সড ডিপোজিটের সুবিধা বা লাভ কেমন
মানুষ ফিক্সড ডিপোজিট করে বেশি লাভের কারণে। অন্যান্য আমানতে টাকা জমা রাখলে ব্যাংক যে হারে সুদ দেয় তার তুলনায় এই আমানতের বিপরীতে অধিক সুদ দিয়ে পাওয়া যায়। তাই মানুষ তাদের অলস অর্থ এফডিআর করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে থাকে। আমাদের দেশের ব্যাংক গুলো এই আমানতের বিপরীতে মেয়াদ ভিত্তিতে ২% থেকে ৯% পর্যন্ত সুদ দিয়ে থাকে। টাকার পরিমাণ ও মেয়াদ বেশি হলে সুদের হারও বেশি হয়ে থাকে। ফিক্সড ডিপোজিটের প্রধান সুবিধা হলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরে নিশ্চিত ভাবে সুদ বা মুনাফা প্রাপ্তি। অন্য কোনো খাতে বিনিয়োগ করলে আপনি নিশ্চিত ভাবে মুনাফা নাও পেতে পারেন।এই আমানতের আরও একটি সুবিধা হলো আপনি আপনার সুবিধামত মেয়াদে টাকা জমা রাখতে পারবেন। মানুষ তাই ফিক্সড ডিপোজিটে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
আপনি যদি ভালো ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করেন তবে আপনি বেশি হারে সুদ পাবেন এবং বিনিয়োগকৃত অর্থ নিয়ে কোনো দুঃচিন্তা করতে হবেনা। তাই এফডিআর করার আগে সকল ব্যাংকের সুদের হার ও তাদের আমানতের অর্থ ফেরত দেওয়ার অতীত রেকর্ড ভালো করে লক্ষ্য করে সঠিক ব্যাংক বাছাই করতে হবে। আরও দেখুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং জব ইন্টারভিউ | ইন্টারভিউর প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবেন
আবার এই আমানতের কিছু অসুবিধাও আছে। আপনি যদি ৬% সুদে ১ বছরের জন্য কোনো ব্যাংকে ১ লক্ষ টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করেন তবে আপনার ৬০০০ টাকা সুদ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো আপনি সম্পূর্ণ সুদের টাকা পাবেন না। ব্যাংক চার্জ, ট্যাক্স ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাদ দিয়ে আপনাকে টাকাটা দেওয়া হবে। তাই ফিক্সড ডিপোজিট করার সময় এই বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
বিভিন্ন ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের সুদের হার
বাংলাদেশের প্রচলিত ব্যাংক গুলোর মধ্যে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক সর্বাধিক ৯% হারে তাদের আমানতকারীদের সুদ দিচ্ছে। আমানতের মেয়াদ ৩ মাস থেকে ১ বছরের কম হলে ব্যাংকটি ৪.৫% থেকে ৫.৫% হারে সুদ দেয়। ১ বছর থেকে ৩ বছরের কম মেয়াদ হলে ৫.৭৫% থেকে ৭% পর্যন্ত আবার ৩ বছর বা তার বেশি হলে ৬% থেকে ৯% হারে সুদ দিচ্ছে।
বেসরকারি ব্যাংক গুলোর মধ্যে পদ্মা ব্যাংক সবচেয়ে বেশি ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতের সুদ দিচ্ছে।ব্যাংকটি তিন মাস থেকে ছয় মাসের কম সময়ের জন্য ৭%, ছয় মাস থেকে ১ বছরের কম সময়ের জন্য ৭.২৫% ও ১ বছরের বেশি সময়ের জন্য ৭.৫% হারে সুদ দিয়ে থাকে। তবে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ঢাকা ব্যাংক সবচেয়ে বেশি সুদ প্রদান করে থাকে।
আমানতের মেয়াদ ৩ বছর বা তার বেশি হলে ব্যাংকটি ৮.২৪% হারে সুদ দিয়ে থাকে। এছাড়া ইসলামী ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের ৫.৫% থেকে ৭.৫% পর্যন্ত মুনাফা দিয়ে থাকে। দীর্ঘ মেয়াদী ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতে দি সিটি ব্যাংক ৮% হারে সুদ দেয়। নিচে আপনাদের সুবিধার জন্য দেশের কয়েকটি শীর্ষ স্থানীয় ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিটের বিপরীতে প্রদত্ত সুদের হার একটি ছকের সাহায্যে দেখানো হলো। আরও দেখুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং কি | সেলস এবং মার্কেটিং এর মধ্যে পার্থক্য
মেয়াদ/ সুদের হার
ব্যাংকের নাম | ৩ মাস | ৬ মাস | ১ বছর | ২ বছর | ৩ বছর |
অগ্রনী ব্যাংক | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ৫-৫.৬০ | ০ | ০ |
জনতা ব্যাংক | ৪.৭৫-৫.৭৫ | ৫.২৫-৫.৮৫ | ৫.৭০-৬.০০ | ০ | ০ |
সোনালী ব্যাংক | ৪.৫০-৫.৬০ | ৪.৭৫-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ০ |
রুপালী ব্যাংক | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ |
বেসিক ব্যাংক | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.৭৫ | ৬.০০ | ৬.০০ | ৬.০০ |
বিডিবিএল | ৫.৫০ | ৫.৫০ | ৫.৫০ | ০ | ০ |
রাকাব | ৪.৫০-৫.৫০ | ৪.৫০-৫.৫০ | ৫.৭৫-৭.০০ | ৫.৭৫-৭.০০ | ৬.০০-৯.০০ |
এবি ব্যাংক | ৫.৬০ | ৫.৬০ | ৫.৭৫ | ৫.৭৫ | ০ |
আল আরাফা | ৩.২৫-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ |
ব্যাংক এশিয়া | ২.৫০-৫.৫০ | ৪.০০-৫.৫০ | ৪.০০-৫.৫০ | ৪.০০-৫.৫০ | ৪.০০-৫.৫০ |
ব্র্যাক ব্যাংক | ৪.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৬.০০ | ৫.৫৫-৬.০০ | ৫.৫৫-৬.০০ | ৫.৫৫-৬.০০ |
ঢাকা ব্যাংক | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৬.২০ |
ডাচ বাংলা | ২.০০-৫.৬০ | ২.৫০-৫.৭০ | ৩.০০-৫.৮০ | ৩.০০-৫.৮০ | ৩.০০-৫.৮০ |
এক্সিম ব্যাংক | ৫.৫০-৫.৭৫ | ৫.৭৫-৫.৯০ | ৫.৯০-৬.০০ | ৫.৯০-৬.০০ | ৫.৯০-৬.০০ |
আইএফআইসি | ৬.০০ | ৬.০০ | ৬.০০ | ৬.০০ | ৬.০০ |
মারকেন্টাইল | ৪.২৫-৫.৬০ | ৪.৫০-৫.৬০ | ৪.৭৫-৫.৬০ | ৪.৭৫-৫.৬০ | ০ |
মেঘনা | ৫.৭৫-৬.০০ | ৬.০০-৬.২৫ | ৬.০০-৬.৫০ | ৫.৭৫-৬.৭৫ | ৫.৭৫-৬.৭৫ |
পদ্মা ব্যাংক | ৬.২৫-৭.০০ | ৬.৫০-৭.২৫ | ৭.০০-৮.৫০ | ০ | ০ |
পূবালি ব্যাংক | ৩.৭৫-৬.০০ | ৪.০০-৬.০০ | ৪.০০-৬.০০ | ৪.০০-৬.০০ | ৪.০০-৭.১৮ |
শাহজালাল | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৭০ | ৪.০০-৫.৭০ | ৪.০০-৫.৭০ |
দি সিটি ব্যাংক | ২.৫০-৬.০০ | ৩.০০-৬.৫০ | ৩.৫০-৭.০০ | ৪.০০-৭.৫০ | ৪.০০-৮.০০ |
ইউসিবিএল | ৩.৭৫-৫.৬০ | ৩.৭৫-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.৫০-৫.৬০ | ৪.৫০-৫.৬০ |
হাবিব ব্যাংক | ৪.৫০-৫.০০ | ৪.৫০-৫.০০ | ৪.৫০-৫.০০ | ৩.০০-৪.০০ | ৪.০০-৬.০০ |
স্ট্যান্ডার্ড চারটাড | ৪.২৫-৫.৫৫ | ৪.৫০-৫.৫৫ | ৪.৭৫-৫.৫৫ | ৫.৫০-৫.৫৫ | ০ |
মিউচ্যুয়াল | ৩.৫০-৫.৭৫ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ |
এনসিসিবিএল | ৩.৭৫-৫.৬০ | ৩.৭৫-৫.৬০ | ৪.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ | ৫.০০-৫.৬০ |
এছাড়াও অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংক সাধারণত ৪% থেকে ৬% হারে সুদ দিয়ে থাকে। সুদের হার নির্ভর করে মেয়াদের উপর। আপনি বেশি মেয়াদে জমা রাখলে বেশি সুদ পাবেন। তাই বেশি মেয়াদের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করায় উত্তম।
ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য যে ব্যাংক আপনার জন্য ভালো হবে
ফিক্সড ডিপোজিট করার আগে আপনার অবশ্যই সকল ব্যাংকের সুদের হার ও ব্যাংক গুলোর মূল্যায়ন সূচক অর্থাৎ বর্তমান মূলধন পরিস্থিতি, ঋণ খেলাপির হার, ক্রেডিট রেটিং, ক্যামেলস রেটিং ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ নিতে হবে। তবে সময়ের সাথে সাথে ব্যাংক গুলোর মূল্যায়নের সূচকের গুরুত্ব কমে গেছে। কারণ দেশের রেটিং প্রতিষ্ঠান গুলোর দুর্বলতার কারণে অনেক খারাপ ব্যাংক ভালো রেটিং পাচ্ছে আবার অনেক ভালো ব্যাংক রেটিং কমের জন্য দুর্বল ব্যাংকের আওতায় পড়ছে। তাই কোন ব্যাংক ভালো আর কোন ব্যাংক খারাপ তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।
একটি ব্যাংক কতটা স্বচ্ছ হবে তা নির্ভর করে তার পরিচালনা পর্ষদের উপর। তাই আপনি যে ব্যাংকে ডিপোজিট করতে চাচ্ছেন সেই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে কেমন ব্যক্তিরা আছেন তা দেখতে হবে। আবার ঐ ব্যাংকের নিয়োগ পক্রিয়া স্বচ্ছ হয় কি না তাও লক্ষ্য করতে হবে। কারণ সৎ ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাংক পরিচালিত হলে ব্যাংকও ভালো হয়। কোন কোন খাতে ব্যাংকটি বিনিয়োগ করে তাও খতিয়ে দেখতে হবে। আরও দেখুনঃ সামাজিক কার্যক্রম কি
গ্রাহকদের জানা দরকার যে ব্যাংক সুদ বেশি দেয় সেই ব্যাংক ভালো নাও হতে পারে। কারণ দুর্বল ব্যাংক গুলোই বেশি সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করে তাদের মূলধন জোগাড় করে। এই সব ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে তা ফেরতে সমস্যা হতে পারে। তাই সব দিক বিবেচনা করে সেরা ব্যাংক বাছাই করতে হবে। তাহলেই আপনার অর্থ সুরক্ষিত থাকবে ও মেয়াদ শেষে সুদ সহ আসল ফেরত পেতে কোনো প্রকার ভোগান্তি পোহাতে হবে না।
আপনি ইসলামিক মাইন্ডের মানুষ হয়ে থাকেন তবে আপনার জন্য দেশে প্রচলিত কিছু ইসলামিক শরিয়াভিত্তিক ব্যাংক গুলোতে ফিক্সড ডিপোজিট করা শ্রেয় হবে। এই সব ব্যাংক মেয়াদ শেষে আপনাকে ভালো মুনাফা প্রদান করবে।
পরিশেষে সবার উদ্দেশ্যে একটি কথা বলব আর তা হলো,শুধুমাত্র বেশি সুদের আশায় আপনার মূল্যবান অর্থ এমন ব্যাংকে রাখবেন না যাতে তা ফেরত পেতে আপনাকে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। কম সুদের হার হলেও যে ব্যাংকে আপনার কষ্টার্জিত অর্থ সুরক্ষিত থাকবে সেই ব্যাংকেই ফিক্সড ডিপোজিট করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
উপরের প্রদত্ত সকল তথ্য সময়ের সাথে পরিবর্তন হতে পারে। তাই আপনাদের ফিক্সড ডিপোজিট করার আগে ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে তথ্যগুলো একবার দেখে নেওয়ার অনুরোধ করা হলো।