আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে সাধারণভাবে শবে বরাত বা লায়লাতুল বারাআত বলা হয়। ফার্সি শব্দ শবে বরাত অর্থ নির্দেশ পাওয়ার রাত্রি। আর আরবী শব্দ লায়লাতুল বারাআত শব্দের অর্থ বিচ্ছেদ বা মুক্তির রাত্রি। আমাদের দেশে শবে বরাত সৌভাগ্যের রজনী হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। অনেক মুসলিম অনুসারীরা মনে করেন এই রাতে বান্দার সারা বছরের ভাগ্য লিপিবদ্ধ করা হয়। আয়ু ও রুযী বৃদ্ধি করা হয় ও এই রাতে বান্দার গোনাহ মাফ করা হয়। আরও দেখুনঃ বাংলাদেশে শবে বরাত কবে ২০২৩
আর মাত্র কয়েক দিন পরেই পবিত্র শবে বরাত পালিত হবে। শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে শবে বরাত বলা হয়। সেই প্রেক্ষিতে আগামি ৭ই মার্চ ২০২৩ সনে দিবাগত রাতে শবে বরাত পালিত হবে।
শবে বরাত আসলেই আমরা অনেকে ভালো ভালো খাবার ও আতশ বাজি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যা একদম উচিত নয়। এই রাতের ফজিলত অনেক। তাই আমরা আজ আলোচনা করব শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে ও এই রাতে কি কি কাজ করা উচিত নয় তা নিয়ে।
শবে বরাতের ফজিলত ও তাৎপর্য
আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য কিছু সময়, রাত বা মাসকে ইবাদত বন্দেগীর জন্য বরকতময় করে দিয়েছেন। শাবান মাস তার মধ্যে অন্যতম। এই মাসে মহান আল্লাহর দয়া ও বরকত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) রমজান মাসের পর এই শাবান মাসেই বেশি বেশি সাওম পালন করতেন। আরও দেখুনঃ শবে বরাতের নামাজের নিয়ম | শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও দোয়া | শবে বরাতের নামাজের নিয়ম কানুন
আয়েশা (রা.) বলেন, “ আমি রসুলুল্লাহ (সা.) কে রমজান মাস ছাড়া অন্য সময় পূর্ণমাস রোজা রাখতে দেখিনি এবং শাবান মাসের মতো অধিক পরিমাণ রোজা অন্য কোনো মাসে রাখতে দেখিনি।” (বুখারি, নাসায়ি)
হজরত উসামা বিন জায়িদ (রা.) বলেন, “আমি একদিন মহানবী (সা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রসুল! আমি আপনাকে শাবান মাসের মতো অন্য কোনো মাসে এত অধিক রোজা রাখতে দেখিনি? উত্তরে তিনি বললেন, এ মাসের ব্যাপারে মানুষ বড়ই উদাসীন। অথচ এ মাসে মানুষের আমলসমূহ মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থাপন করা হয়। আর আমি চাই আমার আমলগুলো (আল্লাহর দরবারে) এমন অবস্থায় পেশ করা হোক যখন আমি রোজাদার।” (নাসায়ি, বায়হাকি)।
রজব এবং শাবান আগমন করলেই রসুলুল্লাহ (সা.) এই দোয়াটি বেশি পাঠ করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিকলানা ফি রজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাদান।’ অর্থ হে আল্লাহ! আমাদের জন্য রজব ও শাবান মাসকে বরকতময় করে দিন এবং আমাদের হায়াতকে রমজান মাস পর্যন্ত পৌঁছে দিন (নাসায়ি)।
মহান আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের মধ্য রজনীকে অনেক বরকতময় ও মহামান্বিত করেছেন। এই সম্পর্কে হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) থেকে বর্ণিত, “হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন, শাবান মাসের মধ্য রাতে (১৫ শাবান) আল্লাহপাক প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং প্রতিটি (মুমিন) বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। তবে পরশ্রীকাতর এবং মুশরিক ব্যতীত।” (কিতাবুস সুন্নাহ, শরহুস সুন্নাহ)।
শবে বরাত নিয়ে আমরা অনেকেই বেশি রকমের বাড়াবাড়ি করে থাকি। আবার অনেকে শবে বরাত পালন হতে বিরত থাকার জন্য বিভিন্ন হাদীস ও যুক্তি দিয়ে থাকেন। তবে শবে বরাত পালনের স্বপক্ষে অনেক হাদীসও রয়েছে। তাই অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি না করে এই রাতে ইবাদত বন্দেগী করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হজরত আয়িশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, “একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো, তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সেজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়িশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)! আপনার দীর্ঘ সেজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না? নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলই ভালো জানেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধশাবানের রাত; এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহ প্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।” (শুআবুল ইমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২)।
উপরের হাদীস গুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি শবে বরাত আমাদের জন্য একটি আশীর্বাদের রাত। এই রাতে আল্লাহর নিকট থেকে গুনাহ মাফ করে নেওয়ার বড় সুযোগ আমাদের। বেশি বেশি নফল নামাজ আদায়, কুরআন পাঠ, দরুদ শরীফ পাঠ, দোয়া ও তসবীহ পাঠ ইত্যাদি ইবাদত করে সারা রাত বা যথা সাধ্য জাগ্রত থাকা আমাদের সকল মুসলিম উম্মাহর জন্য একান্ত প্রয়োজন।
আল্লাহ তায়ালা শবে বরাতের রাতে তার অগণিত বান্দাদের ক্ষমা করে থাকেন। শবে বরাতের ক্ষমা প্রসঙ্গে হযরত আশেয়া (রা.) হতে বর্ণিত আছে, “ নবীজি (সা.) তাঁকে বলেছেন, এ রাতে বনি কালবের ভেড়া বকরির পশমের (সংখ্যার পরিমাণের) চেয়েও বেশিসংখ্যক গুণাহগারকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।” (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ৭৩৯)।
তাই আমাদের এই রাতে আল্লাহর নিকটে বেশি বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। এই রাতে আল্লাহ কাউকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেন না। কিন্তু যারা আল্লাহর সাথে শিরক করে, সুদখোর, পিতামাতার অবাধ্য সন্তান, যিনাকারী, মদ ও জুয়ায় আসক্ত ইত্যাদি ব্যক্তিরা ছাড়া সকলকে আল্লাহ এই রাতে ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন।
শাবান মাস আমাদের জন্য রমজান মাসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। তাই আমাদের এই মাসে বেশি বেশি নফল রোযা আদায় করা উচিত। বিশেষ করে শবে বরাতের রাতে ইবাদত করে পরের দিন রোযা রাখার মর্যাদা অনেক বেশি। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, “যখন শাবানের মধ্য দিবস আসে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করো ও দিনে রোজা পালন করো।” (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
তাই আমরা এই মাসে বেশি বেশি নফল রোযা করার চেষ্টা করব। এতে রমজান মাসে রোযা রাখা আমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। আর যেহুতু আমরা শবে বরাতের রাতে জেগে থেকে ইবাদত করে থাকি, তাই এই রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ বিশেষ করে সালাতুত তাসবিহ নামাজ ও কাযা নামাজ আদায় করা উচিত।
শবে বরাতের রাতে আমাদের যা করা থেকে বিরত থাকা উচিত
শবে বরাত আমাদের জন্য ক্ষমা প্রাপ্তির রাত। কিন্তু আমাদের সমাজে অনেকেই এই রাতে ইবাদত বন্দেগী না করে বিভিন্ন অহেতুক কাজে লিপ্ত থাকে যা কখনই কাম্য নয়। আবার অনেকে এই রাতে অধিক ও উচ্চবিলাসী খাওয়া দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে যা একেবারেই অনুচিত। পবিত্র শবে বরাতের রাতে যে সব কাজ করা উচিত নয় তা হলোঃ
- আতশ বাজি ফুটানো
- হালুয়া রুটি নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা
- ইবাদত না করে অযথা ঘোরাঘুরি করা
- সারা রাত জেগে ফজরের নামাজ না পড়ে ঘুমানো
- অন্যের ইবাদতের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা
সবশেষে বলতে চাই, শবে বরাত নিয়ে পবিত্র কুরআন শরীফে সরাসরি কিছু না বলা থাকলেও বিভিন্ন হাদীস শরীফে এই রাতের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে স্পষ্ট বলা আছে। তাই আমাদের উচিত এই রাতকে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া ও আল্লাহর নিকট থেকে ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য ইবাদত বন্দেগী করা।
তবে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, শবে বরাতের নামে এমন কোনো কাজ করা যাবে না যা এই রাতের পবিত্রতা নষ্ট করে দেয়। ইসলাম অতিরিক্ত কোনো কিছু করাকে নিষিদ্ধ করেছেন। তাই আমরা আল্লাহর নিকট থেকে করুণা প্রাপ্তির আশায় এই রাতে বিভিন্ন ধরনের ইবাদত বন্দেগী করব। আল্লাহ সবাইকে হেফাজতে রাখবেন এই দোয়া করে আজকের মত শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।
ট্যাগঃ শবে বরাতের ফজিলত, শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে হাদিস, পবিত্র শবে বরাতের ফজিলত, শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব, শবে বরাত সম্পর্কে হাদিস।