আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ রচনা- সংকেত: ভূমিকা; স্বপ্নের বাংলাদেশের অভ্যুত্থান; আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ; দুর্নীতিমুক্ত সমাজ; নিরক্ষরতামুক্ত সমাজ; জনসংখ্যার নিয়ন্ত্রণ; আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি; কর্মসংস্থান বৃদ্ধি; ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবন; কারিগরী শিক্ষার প্রসার; আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার; চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নতি; কৃষির উন্নতি; বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি; যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি; অসাম্প্রদায়িক নীতি; গণতন্ত্রের সফল চর্চা; উপসংহার।

রচনা

আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ রচনা

ভূমিকা:

সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আর অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমার প্রিয় বাংলাদেশ। এদেশে ষড়ঋতু তার রূপের ঢালি সাজিয়ে ঋতুচক্রে নেচে বেড়ায়। এদেশের প্রকৃতির মনোরম পরিবেশ আমাদেরকে মুগ্ধ করে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হয়ে গেলেও আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশকে এখনো আমরা পাইনি। প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়ে তার সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার আর সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করে গড়ে তুলতে হবে আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ।

স্বপ্নের বাংলাদেশের অভ্যুত্থান:

প্রায় দুইশ বছরের ব্রিটিশ শাসনের নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে তৎকালীন বাংলা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু বাঙালিদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। তারা বাঙালিদের স্বাধীনতা, ভাষা, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, সামাজিক অবস্থা ও রাজনীতির উপর আঘাত হানে। পাকিস্তানি শাসকেরা প্রথমে আঘাত হানে ভাষার উপর। এতে বাঙালি জাতির জাতীয়তাবাদের প্রকৃত উন্মেষ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট একচ্ছত্রভাবে জয়লাভ করে মন্ত্রিসভা গঠন করলেও ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া হয়নি। ১৯৫৮ সালে পকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সামরিক শাসন জারি করেন এবং বাঙালির উপর শোষণ-নিপীড়ন শুরু করেন। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুথানের ফলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণের পর জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ জয়লাভ করলেও রাষ্ট্রক্ষমতা দেয়া হয়নি। এরই ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতির ঘোষণা দেন। পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পূর্ব পাকিস্তানে “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের পূর্বে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ২৭ মার্চ, ১৯৭১ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণায় বাংলার আপামর জনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করে।

আরও পড়ুনঃ Paragraph

আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ:

যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, স্বপ্ন আর চেতনা নিয়ে বাংলার মানুষ একাত্তরে জীবন দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও তার বাস্তবায়ন হয়নি। তারা চেয়েছিল এমন একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশ যার সর্বত্র আইনের শাসন থাকবে, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা আসবে, স্বাস্থ্য সেবা বৃদ্ধি পাবে, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি হবে এবং মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হবে। ৭১ এ প্রাণোৎসর্গকারী বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের স্বপ্নের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে আমি আমার স্বপ্নের বাংলাদেশের রূপরেখা নিম্নে আলোচনা করছি।

দুর্নীতিমুক্ত সমাজ:

আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত। এজন্য সমাজ থেকে দুর্নীতিকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে। দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে সবাইকে অবহিত করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতিকারীদের যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। নিজে দুর্নীতি করব না এবং অপরকেও দুর্নীতি করতে দেব না এমন মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবেই দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে রেহাই পাবে বাংলাদেশ।

নিরক্ষরতামুক্ত সমাজ গঠন:

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। তারা প্রাথমিক শিক্ষাও অর্জন করতে পারে না। এসব নিরক্ষর মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করছে। তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণে বর্তমান সরকারকে কাজ করতে হবে এবং শিক্ষিত জনসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ:

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭ কোটি। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি। ক্রমবর্ধমান হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ চাপ কমাতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে।

আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি:

বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি করতে হবে। প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিতে হবে। মানুষ যাতে আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করে, দুর্নীতি না করে, ঘুষ না খায়, সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা নষ্ট না করে, ধ্বংসাত্মক কাজ না করে সেদিকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তবেই আমরা স্বপ্নের বাংলাদেশের পানে এগিয়ে যাব।

কর্মসংস্থান বৃদ্ধি:

বাংলাদেশের জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সে হারে কর্মক্ষেত্র বাড়ছে না। ফলে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এসব বেকারদের উপযুক্ত কর্মসংস্থান করতে হবে। এতে দেশের অগ্রগতির সূচনা হবে এবং স্বনির্ভর হবে।

আরও পড়ুনঃ রচনা

ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের পুনরুজ্জীবন:

প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের কুটির শিল্পে তৈরি পণ্যদ্রব্যের খ্যাতি ছিল। বর্তমানেও আন্তর্জাতিক বাজারে এর বিপুল চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আজ এ শিল্পের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতে চলেছে। আমাদের প্রাচীন এ ঐতিহ্যের গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে। এ শিল্পকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে হবে। এ শিল্পে বিনিয়োগ করলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হতে পারে।

কারিগরী শিক্ষার প্রসার:

বাংলাদেশে কারিগরী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত হলে বেকার যুবকরা তাদের কর্মসংস্থান তৈরি করে নিতে পারবে। তারা আর দেশের বোঝা হবে না। তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে দেশের উন্নয়নে অংশ নিবে।

আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার:

বর্তমান বিশ্ব আধুনিক প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’- এ পরিণত করতে হবে। দেশের সর্বক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নতি:

বাংলাদেশের মানুষ এখনও চিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে। তারা চিকিৎসার জন্য ডাক্তার পাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালেও ডাক্তাররা ঠিকমতো সেবা দিচ্ছে না। আবার হাসপাতালও জনসংখ্যার অনুপাতে খুবই কম। চিকিৎসক ও হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে আর বিনা চিকিৎসায় যেন একটি প্রাণও ঝরে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

কৃষির উন্নতি:

বাংলাদেশের মানুষের প্রধান উপজীবিকা কৃষি হলেও কৃষিক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনগ্রসর। এখনও এদেশে প্রাচীন পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করা হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বাড়ছে না। তাই আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে কৃষির উন্নতি ঘটাতে হবে।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি:

বর্তমান বিশ্বের প্রায় সকল কর্মকা- এখন বিদ্যুৎ শক্তির উপর নির্ভরশীল। অফিস, আদালত, কৃষি, শিক্ষা, প্রযুক্তি, কল-কারখানা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যুতের ব্যবহার অত্যাবশ্যক। বিদ্যুৎ ছাড়া উৎপাদনমুখী কর্মকা- চালানো সম্ভব নয়। এই কর্মকান্ডের গতিকে ত্বরান্বিত করতে বাংলাদেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিদ্যুৎ ঘাটতি দূর করে বাংলাদেশকে স্বনির্ভর করার জন্য বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।

যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি:

মানুষের জীবনযাত্রার মানের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন যোগাযোগের উপর নির্ভর করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতি হলে মানুষের যাতায়াত সহজ ও দ্রুততর হবে। পণ্যের আদান-প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, সময়ের অপচয় রোধ প্রভৃতি কাজ মানুষ সহজেই করতে পারবে। ফলে দেশের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ সাধিত হবে।

অসাম্প্রদায়িক নীতি:

বাংলাদেশের নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণের লোক বাস করে। তাদের সবাইকে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে দেখতে হবে। কোনো ধরণের বৈষম্য করা যাবে না। সবাই মিলেমিশে সংঘবদ্ধভাবে দেশের উন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে।

প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা:

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ। এদেশের জনগণকে গণতন্ত্র চর্চায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গণতন্ত্রের সুফল সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করতে হবে। এ দেশে গণতন্ত্র থাকলেও প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চার অভাব রয়েছে তাই প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমে স্বপ্নের বাংলাদেশ তৈরিতে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

উপসংহার:

উপরোক্ত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়িত হলে এদেশের কোনো মানুষকে ক্ষুধার সাথে সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে না, মারা যাবে না কেউ চিকিৎসার অভাবে। সবার মধ্যে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগবে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলবে আমার স্বপ্নের বাংলাদেশ। তবেই এ দেশ হবে বিশ্বের অন্যতম সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ।

Google News