টেলিভিশন রচনা সংকেত: ভূমিকা; টেলিভিশন শব্দের আবিষ্কার ও ব্যাখ্যা; টেলিভিশন আবিষ্কারের প্রেক্ষাপট, টেলিভিশনের প্রথম ব্যবহার, বাংলাদেশ টেলিভিশনের ব্যবহার; টেলিভিশনের প্রয়োজনীয়তা; সংবাদ মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন; বিনোদন মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন; শিক্ষাক্ষেত্রে টেলিভিশন; অন্যান্য ক্ষেত্রে টেলিভিশনের ব্যবহার; নেতিবাচক দিক; উপসংহার।

রচনা

টেলিভিশন রচনা

ভূমিকাঃ

সভ্যতার শুরু থেকে বর্তমান পর্যন্ত মানুষ তার আকাক্সিক্ষত কল্পনাকে বাস্তবায়ন করে চলেছে। অন্ধকার থেকে আলোর যুগে এসেও মানুষ তার আবিষ্কারের অভিযানেই চলেছে। আজ সভ্যতার নতুন যুগে এসে মানুষ আবিষ্কার করে চলেছে নতুন নতুন জিনিস ও যান্ত্রিক কলা-কৌশল। টেলিভিশন বিজ্ঞানের তেমনই এক সংযোজন। টেলিভিশন এ যুগের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী গণমাধ্যম। টেলিভিশন সম্পর্কে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের’ তার এক কবিতায় লিখেছেন

“কত অজানারে জানাইলে তুমি

কত ঘরে দিলে ঠাঁই

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু

পরকে করিলে ভাই।”

টেলিভিশন শব্দের আবিষ্কার ও ব্যাখ্যাঃ

গ্রিক শব্দ ‘টেলি’ এবং লাতিন শব্দ ‘ভিশন’ শব্দযোগে গঠিত ‘টেলিভিশন’ শব্দটি। যার অর্থ হচ্ছে ‘দূরদর্শন’। ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ‘দূরদর্শন শব্দটির প্রবর্তক। এই ‘দূর’ শব্দটির অর্থ দূরত্ব এবং ‘দর্শন’ অর্থ দেখা। অর্থাৎ যা দূর থেকে দেখা যায়। মূলত টেলিভিশন এক বিশেষ ধরণের যন্ত্র। যা উচ্চ শক্তিসম্পন্ন যন্ত্রের সাহায্যে আলোকচিত্রগুলো বায়ুমন্ডলে প্রেরণ করে এবং ট্রান্সমিটারের সাহায্যে সেগুলো গ্রহণ করে পর্দায় দৃশ্যমান করে।

আরও পড়ুনঃ Paragraph

টেলিভিশন আবিষ্কারের প্রেক্ষাপটঃ

জার্মান দার্শনিক ‘পল নেপকো’ সর্বপ্রথম টেলিভিশন সম্পর্কে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেন। পরবর্তীতে তাঁর তত্ত্বের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণা চালানো হয়। এরই ভিত্তিতে ১৯২৬ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী জন লগী বেয়ার্ড সর্বপ্রথম সাদা-কালো ছবির সফল বৈদ্যুতিক সম্প্রচার দেখান। এরই পথ ধরে ১৯৩৬ সালে রুশ বংশোদ্ভুত বিজ্ঞানী আইজাক শোয়েনবার্গ বিশ্বের প্রথম সফল টিভি সম্প্রচার শুরু করেন।

টেলিভিশনের প্রথম ব্যবহারঃ

ইংল্যান্ডে সর্বপ্রথম ১৯৩০ সালে টেলিভিশন চালু হয়। মার্কিন বিজ্ঞানী জোরিকিন-এর তত্ত্বাবধানে আমেরিকায় ন্যাশনাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নিউইয়র্কের এক বইমেলায় প্রথম সে দেশের টিভি সম্প্রচার শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর টেলিভিশন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে এবং উন্নত বিশ্বে ৫০ এর দশকে টেলিভিশনই প্রধান গণমাধ্যম হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে টেলিভিশনের ব্যবহারঃ

১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে, পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়। পরবর্তীতে সরকারিভাবে ১৯৬৮ সালে রামপুরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র চালু হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান টেলিভিশন বাংলাদেশ টেলিভিশন-এ রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৬ সালে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের মাধ্যমে প্রথম ঢাকার বাইরে টিভি সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বর চট্টগ্রামে টিভি কেন্দ্র চালু হয়। প্রথম দিকে বাংলাদেশে শুধু ধনী ও উচ্চবিত্তের ঘরে টেলিভিশন দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও সাধারণ ঘরেও টিভি দেখা যায়। প্রযুক্তির উন্নতির ফলে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিটিভি ছাড়াও এখন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চ্যানেল-এ অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

আরও পড়ুনঃ রচনা

টেলিভিশনের প্রয়োজনীয়তাঃ

বর্তমান বিশ্বে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি, আচার-ব্যবহার, রীতি-নীতি, কৃষ্টি-সভ্যতা প্রভৃতি টেলিভিশনের মাধ্যমে দেখা ও শোনা যায়। এছাড়াও-

– নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে টেলিভিশনের মাধ্যমে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা যায়।

– কৃষির উন্নয়নে টেলিভিশনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যায়।

– ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে তথা উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে প্রচার এবং পণ্যের বাজার বিস্তৃতকরণ টেলিভিশন মাধ্যম হতে পারে।

সংবাদ মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনঃ

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষ সভ্যতার শিখরে উন্নীত হচ্ছে। স্যাটেলাইট বিশ্বকে পরিণত করেছে ‘Global Village’ এ। এর মাধ্যমে বিশ্বের প্রতিমুহূর্তের সংবাদ আদান-প্রদান সম্ভব হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমিকম্প, ঝড় সহ যেকোনো পরিস্থিতির খবর বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে পাওয়া যায় টেলিভিশনের মাধ্যমে।

বিনোদন মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশনঃ

টেলিভিশনকে আমরা বৈচিত্র্যপূর্ণ বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ধরতে পারি। টেলিভিশনের মাধ্যমে আমরা সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, নাটক, চলচ্চিত্র প্রভৃতি অনুষ্ঠান দেখতে পাই। যা আমাদের চিত্ত বিনোদনের অন্যতম উপায়। মানুষ স্বাভাবতই খেলাধূলা, বিনোদন প্রভৃতির উপর আকর্ষণ অনুভব করে। আর আমরা ঘরে বসেই টেলিভিশনের মাধ্যমে সেই চাহিদা পূরণ করতে পারি। যেমন- খেলার মাঠে না গিয়েও অলিম্পিক, বিশ্বকাপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খেলা উপভোগ করতে পারি, আবার সিনেমা হলে না গিয়ে ঘরে বসে নানা ধরণের চলচ্চিত্র উপভোগ করতে পারি। এছাড়া একটি জাতির সাংস্কৃতিক জীবনের অগ্রগতিতে টেলিভিশনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষাক্ষেত্রে টেলিভিশনঃ

সহজ ও সুগম শিক্ষাদানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী মাধ্যম টেলিভিশন। এখানে হাতে-কলমে একত্রে অনেককে এক সাথে শিক্ষাদান করা সম্ভব। এছাড়াও ডিসকভারি, অ্যানিম্যাল প্লানেট, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, হিস্টরি প্রভৃতি চ্যানেলের মাধ্যমে নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। টেলিভিশনে প্রচারিত আলোচনা অনুষ্ঠান, সেমিনার, বিতর্ক প্রভৃতি জ্ঞানকে প্রসারিত করে। এছাড়া টেলিভিশনে ধারণকৃত তথ্য একই সাথে দেখা ও শোনা যায় যা শিক্ষার উপযুক্ত মাধ্যম।

অন্যান্য ক্ষেত্রে টেলিভিশনের ভূমিকাঃ

টেলিভিশনের অন্যান্য ভূমিকাও রয়েছে। যেমন-

– দেশের উন্নয়নে সরকারের ভূমিকা জনগণকে অবহিত করা।

– কোনো বিষয়ে জনমত সৃষ্টি।

– বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা।

– দৃষ্টিকে প্রসারিত করা।

নেতিবাচক দিকঃ

টেলিভিশনের যথোপযুক্ত উপকারীতা সত্ত্বেও এর অপকারীতা যে নেই তা বলা যায় না। টেলিভিশনের কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। যেমন-

* টিভির প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

* টেলিভিশনের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ তরুণদের খেলাধূলা থেকে বিরত রাখে। এতে তারা খেলাধূলা করা থেকে খেলা দেখার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

* স্যাটেলাইটে প্রচারিত বাজে অনুষ্ঠান তরুণদেরকে জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

* তরুণদের নৈতিক অধঃপতন ও সামাজিক অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে কুরুচিপূর্ণ ও স্থুল বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার।

* অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে তরুণদের ভোগপ্রবণ জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে টেলিভিশন।

উপসংহারঃ

টেলিভিশনের সার্থকতা ও ব্যর্থতা মূলত তার ব্যবহারের উপরেই নির্ভর করে। টেলিভিশন যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারলেই এর সফলতা। বর্তমান বিশ্বকে হাতের মুঠোয় আনা সম্ভব হয়েছে এই টেলিভিশনের মাধ্যমে। জাতির উন্নতির স্বার্থে এবং জাতির নৈতিক চরিত্রের উত্তরণ ঘটানোর কাজে টেলিভিশন কার্যকর বাহন হতে পারে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, টেলিভিশন এক কল্যাণকামী গণসংযোগ মাধ্যম এবং কোনো সচেতন ব্যক্তিরই টেলিভিশনের কার্যকরী ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।

Google News