আগামি ৭ই মার্চ ২০২৩ তারিখে মুসলিম উম্মাহ’র পবিত্র রাত শবে বরাত পালিত হবে। মুসলমান ভাই ও বোনেরা এই রাত কাটাবে ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা এই রাতে কিভাবে অর্থাৎ কোন নিয়মে নামাজ আদায় করতে হয়। তাই এই সমস্যা দূর করার লক্ষ্যে আজ আমরা এই আরটিকেলে আলোচনা করব আপনি কোন নিয়মে শবে বরাতের নামাজ আদায় করবেন। তাই শবে বরাতের নামাজের সঠিক নিয়ম জানতে আমাদের সাথেই থাকুন ও আর্টিকেলটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
আরও পড়ুনঃ বাংলাদেশে শবে বরাত কবে ২০২৩
শব শব্দের অর্থ রাত আর বরাত শব্দের অর্থ মুক্তি। শবে বরাত বলতে তাই মুক্তির রজনীকে বুঝায়। এই রাতে মহান আল্লাহ তায়ালা তার সৃষ্ট বান্দাদের দিকে রহমতের দৃষ্টি দিয়ে থাকেন এবং বান্দাদের ছোট ছোট গুনাহ মাফ করে দিয়ে থাকেন। শীরককারী, যিনাকারী, ম-বাবাকে যারা কষ্ট দেয়, সুদখোর, যাদুকর ব্যক্তিদের ছাড়া আল্লাহ এই রাতে তার বান্দাদের সকল পাপ ক্ষমা করে থাকেন ও সকলের ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন।
শবে বরাতের নামাজের নিয়ম ও দোয়া
মুসলিমদের সবচেয়ে পবিত্র মাস রমজান মাসের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে শাবান মাস। তাই এই মাসের ফজিলত অনেক। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এই মাসে বেশি বেশি রোযা রাখতেন।
শবে বরাতে গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের রাসূল (সাঃ) বলেন, “ আমার কাছে শাবান মাসের রোযা অন্য মাসের তুলনায় অধিক প্রিয়। যখন তোমাদের কাছে শাবানের রাত ( শবে বরাত ) হাজির হবে, তখন তোমরা সেই রাত্রটি জাগ্রত থাকো (নামাজ পড়ে, কুরআন তেলয়াত করে, জিকির করে, দোয়া করে) এবং দিনের বেলা সাওম পালন কর। কারণ এ রাতে মহান আল্লাহ সূর্যাস্তের পর থেকে ফজর পর্যন্ত দুনিয়ার আসমানে এসে ঘোষণা করেন, আছে কি আমন কোনো বান্দা যে তার গুনাহ মাফের জন্য আমার কাছে প্রার্থনা করবে? আমি তার গুনাহ মাফ করে দিব। আছে কি এমন কোনো রিজিক প্রার্থনাকারী, যে আমার কাছে রিজিক প্রার্থনা করবে? আমি তার রিজিকের ব্যবস্থা করে দিব। আছে কি এমন কোনো বিপদগ্রস্ত, যে আমার কাছে বিপদ থেকে মুক্তি চাইবে? আমি তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করব। এভাবে সারারাত আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা হতে থাকে এবং বান্দার উপর বৃষ্টির মত রহমত বর্ষিত হতে থাকে।”(ইবনে মাযাহ,২য় খন্ড, হাদিস নং-১৩৮৮)
এছাড়া বুখারি ও মুসলিম শরীফে্র অনুরুপ হাদীস হতে পাওয়া যায়, “আল্লাহ তায়ালা প্রতি রাতের শেষের ভাগে পৃথিবীর নিকটতম আসমানে হাজির হোন এবং বান্দাদের দোয়া কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন।”
তাই আমাদের উচিত এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগী করা। আল্লাহর কাছে নিজেদের গুনাহর জন্য ক্ষমা চাওয়া ও সকল আত্বীয় স্বজনদের জন্য প্রার্থনা করা। মুসলিম ধরমালম্বীদের মতে এই রাতেই আল্লহা তায়ালা বান্দার ভাগ্য নির্ধারণ করে থাকেন। তাই আমাদের উত্তম রিযিকের জন্য এই রাতে বেশি বেশি দোয়া করতে ও ইবাদত করতে হবে।
শবে বরাতের নামাজের নিয়ম
ইবাদতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো নামাজ। আর নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ইবাদত হলো নফল নামাজ। শবে বরাতের রাতে আমরা নফল নামাজ আদায় করে থাকি। শবে বরাতের নামাজের জন্য আলাদা কোনো নিয়ম নেই। অন্যান্য নফল নামাজের মতই শবে বরাতের নফল নামাজ আদায় করতে হয়।
যারা নফল নামাজের জন্য আলাদা নিয়ম তৈরি করেন মূলত তারা নতুন বিদাআত সৃষ্টি করেন। শবে বরাতের নফল নামাজের নিয়ম আর অন্যান্য নফল নামাজের নিয়ম যে একই এই ব্যপারে প্রায় সকল বিখ্যাত আলেমগণ একমত হয়েছেন। তাই শবে বরাতের নফল নামাজের জন্য আলাদা কোনো নিয়ম পালন করা যাবে না।
শবে বরাতের নফল নামাজের নিয়ম হলো দুই রাকাত করে অন্যান্য নফল নামাজের মত আদায় করা। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহার সাথে কুরআন শরীফের অন্য যে কোনো সুরা পড়া এবং অন্যান্য নামাজের মতই রুকু, সেজদা ও শেষ বৈঠকের মাধ্যমে দুই রাকাত নামাজ আদায় করা।
দুই রাকাত দুই রাকাত করে যথা সম্ভব নামাজ আদায় করতে হবে। তবে একাধারে নামাজ আদায় না করে চার রাকাত আদায়ের পর কিছুক্ষন বসে দুয়া-দুরুদ পড়া, দোয়া করা, কুরআন তেলওয়াত করা, হাদীস পড়া ইত্যাদি আমল গুলো করা উত্তম। এইভাবে নামাজ আদায় করলে সহজে শরীরে ক্লান্তি আসবেনা ও অধিক সময় ধরে ইবাদত করা সম্ভব হবে।
নফল নামাজের রাকাতের নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা নেই। আপনি আপনার সাধ্য অনুযায়ী নামাজ আদায় করতে পারবেন। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো কিছু চাপিয়ে দেন না। পবিত্র কুরআনে যথাসাধ্য নফল নামাজ আদায়ের কথা বলা আছে। তাই একাধারে নামাজ আদায় না করে মাঝে মাঝে অন্যান্য আমল গুলো করলে শবে বরাতের পবিত্র ও বরকতময় রাতটি আপনি ইবাদতের মাধ্যমেই কাটিয়ে দিতে পারবেন কোনো প্রকার ক্লান্তি ও একঘেয়েমি ছাড়া।
নফল নামাজের মধ্যে একটি ফজিলতময় নামাজ হচ্ছে সালাতুত তাসবিহ। জীবনে একবার হলেও এই নামাজ পড়ার জন্য আমাদের প্রিয় নবী তাগিদ দিয়েছেন। এই নামাজ একটু দীর্ঘ হওয়াতে অনেকেই তা পড়তে অপারগতা প্রকাশ করে। কিন্তু আমরা যেহেতু শবে বরাতে দীর্ঘ সময় রাত্রি জাগ্রত থেকে নফল নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত করে থাকি, তাই এই রাতে আমরা সালাতুত তাসবিহ নামজটি আদায় করতে পারি।
শবে বরাতের হাদিস
এই নামাজ সম্পর্কে একটি হাদীস আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আব্বাস ইবনে আব্দুল মুত্তালিব কে বলেছেন, হে চাচা! আমি কি আপনাকে দিব না? আমি কি আপনাকে প্রদান করব না? আপনি চার রাকাত নামাজ পড়বেন। প্রতি রাকাতে সুরা ফাতেহা ও অন্য একটি সুরা পড়বেন। প্রথম রাকাতে যখন কেরাত পড়া শেষ করবেন তখন দাঁড়ানো অবস্থায় ১৫ বার বলবেন- সুবহানআল্লাহ, ওয়াল হামদুলিল্লাহ,ওয়া লা-ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবর।
এরপর রুকুতে যাবেন এবং রুকু অবস্থায় দোয়াটি ১০ বার পড়বেন। এরপর রুকু থাকে মাথা উঠাবেন এবং ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদায় যাবেন। সিজদাহ অবস্থায় ১০ বার পড়বেন। এরপর সিজদা থেকে মাথা উঠাবেন ও ১০ বার পড়বেন। এই হলো প্রতি রাকাতে ৭৫ বার। আপনি চার রাকাতেই অনুরুপ করবেন।
যখন দ্বিতীয় রাকাতে তাশাহুদ পড়ার জন্য বসবেন, তখন আগে এই তাসবিহ ১০ বার পড়বেন এবং তার পরে তাশাহুদ পড়বেন। তাশাহুদ পড়ার পর এই তাসবিহ পড়বেন না। তারপর আল্লাহু আকবর বলে তৃতীয় রাকাতের জন্য উঠে দাঁড়াবেন। এইভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাতেও উক্ত নিয়মে তাসবিহ পড়বেন।
কোনো এক স্থানে ওই তাসবিহ পড়তে সম্পূর্ণ ভুলে গেলে বা ভুলে নির্দিষ্ট সংখ্যার চেয়ে কম পড়লে পরবর্তী যে রুকনেই স্মরণ আসুক, সেখানকার সংখ্যার সঙ্গে এই ভুলে যাওয়া সংখ্যাগুলোও আদায় করে নেবেন। আর এই নামাজে কোনো কারণে সিজদায়ে সাহু ওয়াজিব হলে সেই সিজদা এবং তার মধ্যকার বৈঠকে ওই তাসবিহ পাঠ করতে হবে না। তাসবিহর সংখ্যা স্মরণ রাখার জন্য আঙুলের কর গণনা করা যাবে না, তবে আঙুল চেপে স্মরণ রাখা যেতে পারে।
যদি আপনি প্রতিদিন এই আমল করতে পারেন, তবে তা করুন। আর যদি না পারেন, প্রতি জুমাবারে একবার। যদি প্রতি জুমাবারে না পারেন, তবে মাসে ১বার পড়ুন। আর যদি মাসেও না পারেন তবে জীবনে একবার হলেও এই আমলটি আদায় করুণ।” (আবু দাউদ, হাদিস নং-১২৯৭; ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-১৩৮৭)
তাই আমাদের সকলের উচিত জীবনে একবার হলেও সালাতুত তাসবিহ নামাজটি আদায় করা। আর এই নামাজ আদায়ের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো শবে বরাতের রাত। এই রাতে এই নামাজ আদায় করতে পারলে শবে বরাতের রাত আমাদের জন্য আরও বরকতময় হয়ে উঠবে।
আশাকরি এই আর্টিকেল থেকে আপনারা শবে বরাতের নামাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। আপনারা যাতে সহি ও সঠিক নিয়মে শবে বরাতের নামাজ আদায় করতে পারেন তার জন্যই আমাদের এই ছোট্ট প্রয়াস।
পরিশেষে বলতে চাই, আমরা শবে বরাতে নামাজ আদায় করব নিজেকে পাপমুক্ত করার জন্য। তাই সঠিক নিয়মে নামাজ আদায় করার চেষ্টা করব। হাদীস ও সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কোনো নিয়মে নামাজ আদায় হতে বিরত থাকব। আল্লাহ এই পবিত্র শবে বরাতের ওসিলায় আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিবেন ও আমাদের হালাল রিজিকের ব্যবস্থা করে দিবেন এই কামনায় আজকের মত শেষ করছি। আল্লাহ হাফেজ।