বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে থাকে। আর এই বিশাল জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের। তাই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সমতির আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। গ্রামের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির ব্যক্তিরা তাদের আর্থিক স্বচ্ছলতার উদ্দেশ্যে নিজেরা সংগঠিত হয়ে সমিতি গঠন করে থাকে। কিন্তু অনেকেই সমিতির নিয়ম কানুন না জেনেই সমিতি গঠন করে থাকে। অনেকে সমিতির কি কি ধারা আছে তাও জানেনা। তাই আপনাদের সুবিধার্থে আমরা আজ বাংলাদেশে প্রচলিত সমিতির গঠন পদ্ধতি ও যে সব নিয়ম কানুন আছে তা নিয়ে আলোচনা করব। আরও দেখুনঃ সমিতির নামকরণ | নতুন সমবায় সমিতির নাম

সমিতির নিয়ম কানুন

সমিতি বলতে কি বুঝায়

যখন একটি সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের জীবন যাত্রার মান ও আর্থিক অবস্থার উন্নতির উদ্দেশ্যে কিছু নিয়ম কানুন মেনে একটি কাঠামোর ভিতর থেকে সবাই মিলে এক সাথে কাজ করে তাকে সমিতি বলে। সমিতির সবারই একটি অভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে এবং সেই উদ্দেশ্য পূরনেই সকলে একত্রে কাজ করে থাকে। 

একই পেশায় নিয়োজিত কয়েকজন ব্যক্তি যখন নিজেদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়ে কোনো সংগঠন গড়ে তুলে তাকে সমবায় সমিতি বলে। সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য পারস্পারিক কল্যাণ সাধন, মুনাফা অর্জন করা নয়। আরও দেখুনঃ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৩

সমবায় সমিতি গঠনের নিয়ম নীতি

প্রত্যেক দেশের সমবায় সমিতি গুলো সেই দেশের বিদ্যমান আইন অনুসরণ করে গঠিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশের সমবায় সমিতি গুলো গঠিত হয় বাংলাদেশে প্রচলিত সমবায় সমিতি আইন অনুযায়ী। সমবায় সমিতি একটি আইনসৃষ্ট কৃত্রিম ব্যক্তিসত্ত্বা বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠান। একটি সমবায় সমিতি গঠনের জন্য যে সব নিয়ম নীতি অনুসরণ করতে হয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো।

  • একটি সমবায় সমিতি গঠনের জন্য সর্ব প্রথম প্রয়োজন ২০(বিশ) জন ব্যক্তি যাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর। মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন ও ১৮ বছর বয়সের চেয়ে ছোট কোন ব্যক্তি সমতির সদস্য হতে পারবেনা।
  • সকল সদস্যদের উপস্থিতিতে সমিতির সভায় যে সব সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে তা সত্যায়িত করে নিবন্ধনের জন্য প্রেরিত আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে। 
  • সমিতির পরিচালনার দলিল নামে পরিচিত নমুনা উপ আইন জেলা/উপজেলা সমবায় অফিস থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এই উপ আইন সমিতির সদস্যরাই প্রণয়ন করবে ও তাতে কমপক্ষে ২০ জন সদস্যের স্বাক্ষর নিশ্চিত করতে হবে। 
  • সমিতির অবশ্যই শেয়ার মূলধন থাকতে হবে। প্রাথমিক সমিতি নিবন্ধনের জন্য এই মূলধনের পরিমাণ নিম্নে ২০,০০০ টাকা হতে হবে। সমিতির প্রত্যেক সদস্যকে অবশ্যই শেয়ার ক্রয় করতে হবে ও শেয়ার মূল্যের সম পরিমাণ অর্থ সমিতির সঞ্চয়ী হিসাবে জমা দিতে হবে। 
  • নিবন্ধনের পূর্বেই সমিতির জমা খরচ বহি, শেয়ার ও সঞ্চয় রেজিস্টার, সাধারণ রেজিস্টার, সদস্য রেজিস্টার, রেজুলেশন বহি, সাধারণ সভার বহি, নোটিশ বহি ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে হবে এবং ব্যাংকে একটি হিসাব খুলতে হবে।
  • সমিতির প্রকৃতি অনুযায়ী নিবন্ধন ফি জমা দানের চালান কপি আবেদনের সাথে সংযুক্ত করতে হবে।
  • সমিতির সাংগঠনিক সভায় সমিতির সকল কাজ পরিচালনার জন্য একটি সমিতি ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে। 
  • সমিতির প্রত্যেক সদস্যের ছবি ও মোবাইল নম্বর সহ সকল তথ্য দিয়ে নির্ধারিত আবেদন ফরম সদস্য নিজে পূরন করবে। 
  • নিবন্ধনের জন্য সকল কাগজ পত্র প্রস্তুত হলে তা সংশ্লিষ্ট উপজেলা/মেট্রোপলিটন  সমবায় অফিসে জমা দিতে হবে। 

সমিতির নিয়ম কানুন

সমবায় সমিতি নিবন্ধনের জন্য যে সব কাগজ-পত্র  জমা দিতে হয় তা আপনাদের সুবিধার জন্য সংক্ষেপে নিচে উল্লেখ করা হলো।

  • নির্ধারিত ফরমে আবেদনপত্র
  • নিবন্ধন ফি জমার চালান কপি
  •  সাংগঠনিক সভার সত্যায়িত রেজুলেশন
  • জমা খরচ হিসাব
  • তিন প্রস্থ উপ-আইন
  • আগামি দুই বছরের প্রস্তাবিত বাজেট
  • নাগরিকত্ব ও স্থায়ী ঠিকানা সংক্রান্ত প্রমাণপত্র
  • আবেদনকারী সকল সদস্যের সত্যায়িত ছবি
  • নিবন্ধকের অনুমোদনের জন্য প্রথম ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রস্তাব

উপরোক্ত সকল কাগজ পত্র উপজেলা সমবায় অফিস যাচাই বাছাই ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জেলা সমবায় অফিসে নিবন্ধনের জন্য জেলা সমবায় অফিসে প্রেরন করবে। এরপর নিবন্ধনকারী কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিবন্ধক আবেদন পত্রের সাথে সংযুক্ত সকল কাগজ পত্র দেখে সন্তুষ্ট হলে প্রস্তাবিত সমতিটিকে নিবন্ধন করে নেন। 

নিবন্ধনের আদেশ পাওয়ার সাথে সাথে সমিতিটি আইনগত মর্যাদার অধিকারী হয় এবং নিজ নাম ও সিল ব্যবহার করে সমিতির কাজ শুরু করতে পারে। এইভাবে একটি সমিতির গঠন প্রণালী শেষ হয়। আরও দেখুনঃ সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ডিপিএস | সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ডিপিএস তালিকা

সমিতি পরিচালনার নীতিমালা

একটি সমিতি কতটুকু সাফল্য পাবে তা নির্ভর করে এই পরিচালনা নীতির উপর। পরিচালন নীতি সঠিক না হলে সেই সমিতি বেশি দিন টিকতে পারেনা। বাংলাদেশের এমন অনেক সমিতি আছে যে গুলো শুধুমাত্র সঠিক পরিচালনার অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই একটি সমিতিকে দীর্ঘ দিন টিকিয়ে রাখতে ও সফল করতে যে সকল নীতি অবলম্বল করা উচিত তা নিচে বর্ণনা করা হলো।

  • একতাঃ ‘একতাই বল’ এই কথাটির উপর ভিত্তি করেই সমিতি গঠন হয়ে থাকে। তাই সমিতির সকল সদস্যকে সকল বাধা বিপত্তি মোকাবেলা করার জন্য সব সময় একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে হবে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ-মারামারি ভুলে একত্রে কাজ করতে হবে। 
  • সাম্যঃ সমবায় সমিতির অন্যতম আদর্শ হলো সকলের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সমিতির সদস্যদের মধ্যে কে সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বড় তা এখানে মূখ্য বিষয় নয়। এখানে সকলের মর্যাদায় সমান।
  • সহযোগিতাঃ সমিতির সকল সদস্যের সহযোগিতামূলক মনোভাব থাকতে হবে। একে অপরের প্রতি হিংসা না করে সহযোগিতার মাধ্যমে সকল কাজ করতে হবে। 
  • সমভোটাধিকারঃ সমবায় সমিতিতে সকল সদস্যের সম-ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়।  কারও শেয়ারের পরিমাণ বেশি হলেও সে একটির বেশি ভোটের অধিকার পাবেনা। 
  • মুনাফা বন্টনঃ সমবায় সমিতির একটি অন্যতম নীতি হলো মুনাফার সম্পূর্ণ অংশ সদস্যদের মাঝে বন্টন না করে অর্জিত মুনাফার ১৫% সঞ্চিতি তহবিলে ও ৩% উন্নয়ন তহবিলে স্থানান্তর করা। 
  • নিরপেক্ষতাঃ সমবায় সমিতিতে যে কোনো ধর্মের ও যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের ব্যাক্তিরা তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম, দল, বর্ণ ভুলে নিরপেক্ষ থেকে একত্রে কাজ করবে। এটাই সমবায় সমিতির মূল আদর্শ।
  • গণতন্ত্রঃ সমিতিতে গণতন্ত্রের চর্চা থাকতে হবে। সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি নির্বাচন ও সকল গৃহীত সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক উপায়ে হতে হবে। আরও দেখুনঃ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কি কি
  • প্রশিক্ষনের ব্যবস্থাঃ কর্মীদের কাজে দক্ষ করার জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা সমিতির অন্যতম নীতি।
  • সমিতির উপ আইন সম্পর্কে জ্ঞান থাকাঃ সমিতির উপ আইনে যে সব কার্যাবলীর বিবরণ আছে সেই সব সম্পর্কে সমিতির সকল সদস্যের সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকতে হবে। 
  • অবসায়নঃ সমিতি একটি আইনগত সত্ত্বার অধিকারী। তাই কোনো সদস্যের ইচ্ছার উপর সমিতির অবসায়ন ঘটেনা।

এছাড়া একটি ভালো সমিতির আরও কিছু গুণাবলী থাকা আবশ্যক।যেমনঃ

  • সমিতির সদস্য সংখ্যা ২০ থেকে ৩৫ জনের মধ্যে থাকতে হবে।
  • সদস্যরা সমিতির যে কোনো সভায় সময়মত উপস্থিত হবে।
  • নিয়মিতভাবে সঞ্চয় ও কিস্তি প্রদান করবে।
  • সকল সদস্যই নিজের ও সমিতির সঞ্চয় সম্পর্কে অবগত থাকবে। 
  • হাজিরা খাতায় সকলের স্বাক্ষর থাকবে।
  • সকল সদস্য সমিতির সকল নিয়ম কানুন মেনে চলবে।
  • পরিচালনা কমিটি সক্রিয় থাকবে।
  • সমিতির সকল সদস্য সৎ ও কর্মঠ হবে।

উপরোক্ত সকল নিয়ম নীতি মেনে চললে একটি সমিতি সফলতার মুখ দেখবে বলে আমরা মনে করি। তাই সমিতির কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জনে সমিতির সকল সদস্যের উপরের সব নিয়ম নীতি অনুসরণ করা একান্ত জরুরী। 

সমতির অবসায়ন পদ্ধতি

সমিতির সদস্যরা সমিতি পরিচালনায় অনাগ্রহী হলে জেলা সমবায় অফিস বরাবর অবসায়নের আবেদন করে নিবন্ধন বাতিল করতে পারবেন। আবার সমিতির মূলধন নির্ধারিত হারের চেয়ে কম হলে অথবা সমিতি আইনের পরিপন্থি কোনো কাজে জড়িত হলে নিবন্ধন বাতিলের মাধ্যমে সমিতি অবসায়ন করতে পারবে।  আরও দেখুনঃ ফিক্সড ডিপোজিট করার জন্য কোন ব্যাংক সবচেয়ে ভাল

একটি সফল সমিতিই পারে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটাতে। সমিতি গঠনের মাধ্যমে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবে ও দেশকে দ্রুত উন্নত দেশে পরিণত করবে এটাই আমাদের কাম্য।  তাই সমিতি গঠন করার পূর্বে বাংলাদেশের সমবায় আইন সম্পর্কে ভালোভাবে ধারণা গ্রহণ করা উচিত।

 আশাকরি এই আর্টিকেল আপনাদের সমিতির নিয়ম কানুন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছে। সমিতি সম্পর্কে আরও জানতে ‘বাংলাদেশ সমবায় সমিতি আইন’ এর ওয়েবসাইট দেখতে পারেন। ধন্যবাদ।            

Google News