আমরা যারা বিভিন্ন চাকুরী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি তখন প্রায় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হই যে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কয়টি ও কি কি। অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যান। তাই আপনাদের সকল দ্বিধা দূর করতে আমরা আজ এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। শুধুমাত্র চাকুরীর পরীক্ষায় উত্তর দিতেই নয়, সকল শিক্ষিত সচেতন নাগরিকদের বাংলাদেশের সকল প্রকার ব্যাংক সম্পর্কে অবগত থাকা একান্ত জরুরী।আরও দেখুনঃ দেউলিয়া ব্যাংক তালিকা ২০২৩
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কি কি
ব্যাংকের প্রকারভেদ
বাংলাদেশে যে সব ব্যাংক পরিচালিত হয় সেই সকল ব্যাংক গুলোকে প্রধানত দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংক। আমাদের দেশে তালিকাভুক্ত ব্যাংক রয়েছে ৬১ টি এবং অ-তালিকাভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা পাঁচ। তালিকাভুক্ত ব্যাংক গুলোর মধ্যে ৬ টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক,৪৩ টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩ টি রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক ও ৯ টি বিদেশি ব্যাংক।আরও দেখুনঃ আজকের বাজার দর ২০২৩
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
যে সব ব্যাংকের শতভাগ বা প্রায় শতভাগ মালিকানা সরকারের হাতে থাকে এবং সরকারের নিয়ম কানুন মেনে পরিচালিত হয় তাকে সরকারি বা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক বলে। এই সকল ব্যাংকের মালিক রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বে পরিচালিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সংখ্যা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকেন। মূলত বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ৯ টি। এর মধ্যে ৬ টি বাণিজ্যিক এবং ৩ টি বিশেষায়িত ব্যাংক। নিচে ব্যাংক গুলো নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনা করা হলো।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক
যে সব বাণিজ্যিক ব্যাংক সরকারের দায়িত্বে পরিচালিত হয় ও সরকারের সকল নিয়ম কানুন মেনে চলে সে সব ব্যাংক গুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক বলে। এই দেশে ৬ টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক রয়েছে। যথাঃ
১। সোনালী ব্যাংক লিমিটেড
২। জনতা ব্যাংক লিমিটেড
৩। অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড
৪। রূপালী ব্যাংক লিমিটেড
৫। বেসিক ব্যাংক লিমিটেড
৬। বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড
এই সব ব্যাংকের মালিক বাংলাদেশ সরকার এবং সরকারি সকল আদেশ নিষেধ মানতে ব্যাংক গুলো বাধ্য থাকে। নিচে ব্যাংক গুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো। আরও দেখুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং জব ইন্টারভিউ | ইন্টারভিউর প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবেন
সোনালী ব্যাংক লিমিটেড
বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো সোনালী ব্যাংক। ব্যাংকটি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান, ব্যাংক অব ভাওয়ালপুর ও প্রিমিয়ার ব্যাংক এই তিনটি ব্যাংক নিয়ে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক্স অর্ডার ও রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ নম্বর ২৬ অনুযায়ী সোনালী ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৭ সাল থেকে ব্যাংকটি লিমিটেড কোম্পানী হিসেবে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করা আসছে।
বিদেশে ২ টি শাখা সহ বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের মোট শাখার সংখ্যা ১২২৯ টি। দেশের আর কোনো ব্যাংকের এত শাখা নেই। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ব্যাংকের শাখা রয়েছে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছে। সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত।
জনতা ব্যাংক লিমিটেড
এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক। ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড ও ইউনিয়ন ব্যাংক লিমিটেড নিয়ে জনতা ব্যাংক গঠিত হয়। ১৯৭২ সালে ব্যাংকটি জাতীয়করণ করা হয় এবং ২০০৭ সাল থেকে লিমিটেড কোম্পানীতে রুপান্তরিত হয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। বর্তমানে এই ব্যাংকের শাখা রয়েছে ৯১২ টি। এই ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় মতিঝিলে অবস্থিত। আরও দেখুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং কি | সেলস এবং মার্কেটিং এর মধ্যে পার্থক্য
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড
বাংলাদেশের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো অগ্রণী ব্যাংক। সাবেক হাবিব ব্যাংক ও সাবেক কমার্স ব্যাংক নিয়ে এই ব্যাংক গঠিত হয় ও ১৯৭২ সালে জাতীয়করণ করা হয়। এই ব্যাংকের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয় অনলাইন ব্যাবস্থাপনায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গুলোর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক সর্ব প্রথম ২০১০ সালে ইসলামী ব্যাংকিং ইউনিট চালু করে। বর্তমানে এই ব্যাংকের অনলাইন শাখার সংখ্যা ৯৬২ টি।
রূপালী ব্যাংক লিমিটেড
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক হলো রূপালী ব্যাংক। ১৯৭২ সালে মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, অস্ট্রেলেশিয়া ব্যাংক ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সকল সম্পদ ও দায় নিয়ে এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যাংকটির ৫১% মালিকানা সরকারের ও অবশিষ্ট মালিকানা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ৫৮৬ টি শাখা নিয়ে ব্যাংকটি সারা দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
বেসিক ব্যাংক লিমিটেড
দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে শক্তিশালী করতে ও নতুন নতুন ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তুলতে অর্থায়নের উদ্দেশ্যে ১৯৮৮ সালে বেসিক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯২ সালে ব্যাংকটির ১০০% শেয়ার বাংলাদেশ সরকার ক্রয় করে এবং এর মালিকানা সম্পূর্ণ সরকারের। দেশের শিল্প খাত প্রসারের জন্য ব্যাংকটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অর্থায়ন করে থাকে। এই ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের প্রায় অর্ধেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য বরাদ্দ থাকে। এই ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ৭২ টি ও প্রধাণ কার্যালয় মতিঝিলে অবস্থিত।
বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড
বাংলাদেশের আরও একটি অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড বা বিডিবিএল। দেশের শিল্প খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একিভূত করে বিডিবিএল গঠন করা হয়। এই ব্যাংক শিল্প খাতে দীর্ঘ ও মধ্য মেয়াদী ঋণ দিয়ে থাকে। সারা দেশে বিডিবিএল এর ৫০টি শাখা রয়েছে। বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাতের বেহাল অবস্থার মধ্যেও বিডিবিএল অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক
এই ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ছাড়াও আরও ৩ টি রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক রয়েছে। যথাঃ
১। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
২। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
৩। প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক
ব্যাংক গুলোর সম্পূর্ণ মালিকানা সরকারের হাতে। নিচে ব্যাংক গুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আপনাদের সামনে তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
বাংলাদেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংক হলো বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। দেশের কৃষি খাতে অর্থায়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে ব্যাংকটি গঠন করা হয়। গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করায় এই ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য। বিশেষায়িত ব্যাংক হলেও এই ব্যাংক অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকের মত আমানত গ্রহণ, ঋণ প্রদান, বৈদেশ্যিক বাণিজ্যসহ সকল ধরনের আধুনিক ব্যাংকিং পরিচালনা করে আসছে। ১০৩৮ টি শাখার মাধ্যমে সারাদেশে এই ব্যাংক জন সাধারণকে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করছে। আরও দেখুনঃ ফিক্সড ডিপোজিট করার জন্য কোন ব্যাংক সবচেয়ে ভাল
রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল তথা রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কৃষি ঋণ সরবরাহের উদ্দেশ্যে ১৯৮৭ সালে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রধান কার্যালয় রাজশাহীতে অবস্থিত। এই দুই বিভাগে ৩৮৪ টি শাখা নিয়ে এই ব্যাংক তাদের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক
প্রবাসী বাংলাদেশীদের আর্থিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা লাভ করে। মূলত বিদেশগামী কর্মীদের স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান করে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করায় এই ব্যাংকের প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়া বিদেশ ফেরত কর্মীদের অর্থায়নের মাধ্যমে কর্ম সংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া এই ব্যাংকের অন্যতম উদ্দেশ্য। এই সকল লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সারাদেশে ১০১টি শাখা নিয়ে এই ব্যাংক তাদের ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে আসছে।
আশাকরি উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক সম্পর্কে সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবেন। আমাদের আর্টিকেলটি পড়ার জন্য সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে আজকের মত শেষ করছি। সকলে নিরাপদ ও সুস্থ থাকবেন।