বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য রচনা- সংকেত: বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য; ষাটগম্বুজ মসজিদ; ছোট সোনা মসজিদ; তারা মসজিদ; কান্তজির মন্দির; পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার; শালবন বৌদ্ধ বিহার; লালবাগ কেল্লা; প্রাচীন স্থাপত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব; উপসংহার।

রচনা

বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য রচনা

ভূমিকা:

একটি দেশের প্রাচীন স্থাপত্য সেই দেশের ইতিহাসের ধারক ও বাহক। দেশটি কত উন্নত ছিল, তার কৃষ্টি ও সংস্কৃতি কতটা উৎকর্ষ লাভ করেছিল তা জানা যায় তার ইতিহাস ও ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখে। বাংলাদেশের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। আর এই প্রাচীনত্বের সাক্ষী এর প্রাচীন স্থাপত্যগুলো। প্রাচীনকালের এই স্থাপনাগুলো মূলত তৈরি করা হয়েছিল রাজকার্য পরিচালনা, সংস্কৃতি চর্চা এবং ধর্মচর্চার প্রতিষ্ঠান হিসেবে। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন শাসকের আমলে নির্মিত এই স্থাপনাগুলো তাই বহন করে ধর্ম, সংস্কৃতি ও বিভিন্ন শাসনামলের ইতিহাস।

বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপত্য:

প্রাচীনকালে স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছিল সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার কেন্দ্র হিসেবে। তাই এই প্রাচীন স্থাপনার মধ্যে মসজিদ, মন্দির, বৌদ্ধ বিহার প্রধান। প্রাচীন মসজিদের মধ্যে ষাটগম্বুজ মসজিদ, তারা মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ প্রধান। মন্দিরের মধ্যে কান্তজির মন্দিরই বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। অন্যদিকে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার হলো পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার ও শালবন বৌদ্ধ বিহার। লালবাগ কেল্লা প্রশাসনিক দিক দিয়ে প্রধান। নিম্নে বাংলাদেশের কয়েকটি প্রাচীন স্থাপত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ষাটগম্বুজ মসজিদ:

ষাটগম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে (১৪৩৫-১৪৫৯) খানজাহান আলী সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে স্থাপন করেন খলিফাবাদ রাজ্য। খানজাহান বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হলো নির্মাণ করেন, পরে তা ষাটগম্বুজ মসজিদ নামে পরিচিত পায়। এ মসজিদটি বহু বছর ধরে বহু অর্থ খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছিল। এর পাথরগুলো আনা হয়েছিল রাজমহল থেকে। তাছাড়া তুঘলকি ও জৌনপুরী বিখ্যাত নির্মাণশৈলী এতে সুস্পষ্ট। পনের শতকে নির্মিত এই মসজিদটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের একটি।

ছোট সোনা মসজিদ:

ছোট সোনা মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন মসজিদ। প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে ফিরোজপুর গ্রামে এ মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল যা বর্তমান রাজশাহী বিভাগের চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার অধীনে পড়েছে। সুলতান আলাউদ্দীন শাহের শাসনামলে (১৪৯৩-১৫১৯) ওয়ালী মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তি নির্মাণ করেছিলেন এই মসজিদ। পুরো মসজিদের অলঙ্করণে মূলত ইট, পাথর ও টেরাকোটা ব্যবহৃত হয়েছে। মসজিদের সম্মুখভাগ ও দরজায় বিভিন্ন কারুকার্য খোদাই করা রয়েছে। ক্রেইটন ও কানিংহামের বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় এক সময় বাইরের দিকে পুরো মসজিদটির উপর সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল, সূর্যের আলো পড়লে এ রঙ সোনার মতো ঝলমল করত। প্রাচীন গৌড়ে আর একটি সোনা মসজিদ ছিল, সেটি নির্মাণ করেন সুলতান নুসরত শাহ। সেটি ছিল আরও বড়ো। তাই স্থানীয় লোকজন এটিকে ছোটো সোনা মসজিদ বলে অভিহিত করতো।

আরও পড়ুনঃ Paragraph

তারা মসজিদ:

তারা মসজিদ পুরনো ঢাকার আরমানিটোলায় আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত। সাদা মার্বেলের গম্বুজের ওপর নীলরঙা তারায় খচিত এ মসজিদ নির্মিত হয় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। জানা যায় আঠারো শতকে ঢাকার ধনাঢ্য ব্যক্তি জমিদার মির্জা গোলাম পীর এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মির্জা সাহেবের মসজিদ হিসেবে তখন এটি পরিচিতি লাভ করে। ১৮৬০ সালে মারা যান মির্জা গোলাম পীর। পরে ১৯২৬ সালে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী জান বেপারি মসজিদটির সংস্কার করেন। এই মসজিদে মোঘল স্থাপত্য শৈলীর প্রভাব রয়েছে।

কান্তজির মন্দির:

কান্তজির মন্দির বা কান্তজীউ মন্দির বা কান্তনগর মন্দির দিনাজপুর শহর থেকে কুড়ি কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে সাত কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর- তেতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের উত্তর দিকে ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তাঁর শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ আরম্ভ করেন। ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পোষ্য পুত্র রামনাথ রায় ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে পোড়ামাটির ফলকে চিত্রিত রয়েছে রামায়ন মহাভারতের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীচিত্র। পুরো মন্দিরের কারুকার্যে প্রায় পনের হাজারের মতো টেরাকোটা টালি ব্যবহৃত হয়েছে।

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার:

পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার বা সোমপুর বিহার বা সোমপুর মহাবিহার বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত অন্যতম প্রাচীন স্থাপনা। পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা শ্রী ধর্মপালদেব খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের শেষের দিকে বা নবম শতকের প্রথম দিকে এই বিহার স্থাপন করেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রত্নতাত্বিক গবেষক স্যার কানিংহাম আবিষ্কার করেন বাংলাদেশের এই প্রাচীন স্থাপনাটি। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান এর মর্যাদা দেয়। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বাদলগাছি উপজেলার পাহারপুর গ্রামে অবস্থিত এই বিহার। এই বিহারটি মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্র্ম ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র ছিল।

আরও পড়ুনঃ রচনা

শালবন বৌদ্ধ বিহার:

শালবন বৌদ্ধ বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। কুমিল্লার কোটবাড়িতে অবস্থিত এই বিহারটির আশেপাশে একসময় বিশাল শালবন ছিল বলে এর নামকরণ করা হয়েছিল শালবন বিহার হিসেবে। ধারণা করা হয় খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথমভাগে এই বিহার নির্মাণ করেন দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রী ভবদেব। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধর্মচর্চা ও বিদ্যাশিক্ষার কেন্দ্র ছিল এই বিহার। প্রত্নতাত্বিক খননের সময় বিহারটির ধ্বংসাবশেষ থেকে আটটি তাম্রলিপি, ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা এবং অসংখ্য পোড়ামাটির ফলক, টেরাকোটা ও ব্রোঞ্জমূর্তি পাওয়া যায়।

লালবাগ কেল্লা:

লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশর রাজধানী শহর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রাচীন দুর্গ। নির্মাণের শুরুতে এই দুর্গের নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র আজম শাহ ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদারের বাসস্থান হিসেবে এই দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু করেন। মাত্র এক বছর পরেই নির্মাণ কাজ শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্রাট আওরজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এ সময় মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। পরবর্তীকালে নবাব শায়েস্তা খাঁ ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এর নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর এ দুর্গ অপয়া মনে করে নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরী বিবিকে দরবার হল ও মসজিদের ঠিক মাঝে সমাহিত করা হয় যা পরী বিবির মাজার নামে পরিচিত। শায়েস্তা খাঁ দরবার হলে বসে কাজকর্ম পরিচালনা করতেন। ১৯১০ সালে লালবাগ কেল্লা সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়।

প্রাচীন স্থাপত্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব:

বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী। এই স্থাপত্যগুলো থেকে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে জানা যায় তৎকালীন সময়ের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা ও সমাজব্যবস্থার চিত্র। এই দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বাংলাদেশের প্রাচীন স্থাপনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া এই স্থাপনাগুলো পরিদর্শন করতে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শক জড়ো হয়। ইতিহাস আর জ্ঞান পিপাসু মানুষের প্রতিনিয়ত সমাগম হয় এ সকল স্থানে। তাই ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এই স্থাপনাগুলোর সংরক্ষণ ও সংস্কার সাধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার:

আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতির রূপরেখা এবং প্রাচীন ইতিহাস জানার অন্যতম মাধ্যম প্রাচীন স্থাপনা। তাই ইতিহাস প্রেমীদের কাছে এগুলো অনেক মর্যাদাসম্পন্ন। তাই দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে এসব পুরাকীর্তির যথাযথ সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধান খুবই প্রয়োজনীয়।

Google News