একটি দেশের অর্থনীতি কতটুকু শক্তিশালি তা বুঝা যায় সেই দেশের ব্যাংক গুলোর সার্বিক অবস্থা দেখে। ব্যাংক খাত শক্তিশালী হলে দেশের অর্থনীতিও দৃঢ় হয়। কিন্তু কিছু কিছু কারণে ব্যাংক খাতে অস্থিরতা তৈরি হয়। সাম্প্রতিক সময়ের একটি বহুল আলোচিত টপিক হলো কিছু ব্যাংকের দেউলিয়া পর্যায়ে পৌছে যাওয়া। এতে করে অনেক মানুষ তাদের ব্যাংকে আমানতের অর্থ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। তাই আমরা আজ এই আলোচনার মাধ্যমে আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব যে একটি ব্যাংক কিভাবে এই সংকটে পড়ে, বাংলাদেশ ব্যাংক কোন কোন ব্যাংক গুলোকে দুর্বল ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত করেছে, দেউলিয়া ব্যাংক তালিকা ২০২৩ এবং এইসব ব্যাংকের আমানতকারীদের ঝুঁকি কত টুকু। তাহলে চলুন বিস্তারিত তথ্য জেনে নেওয়া যাকঃ
দেউলিয়া ব্যাংক তালিকা ২০২৩
একটি ব্যাংক যেভাবে সংকটে পড়ে
একটি ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়ে তখনি যখন তার খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। করোনা সময়কালে ব্যাংক গুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে ব্যাংক গুলোর ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায় ও আমানতকারীদের সঠিক হারে মুনাফা দিতে ব্যর্থ হয়।এই সব কারণে ব্যাংক গুলো মুনাফা করতে পারছে না। ফলে কয়েকটি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে ও মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে। আরও দেখুনঃ আজকের বাজার দর ২০২৩
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের ১ম তিন মাসে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালের সেপ্টেমবর মাস পর্যন্ত বিতরন করা ১৪ লাখ ৩৬ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে পড়েছে। যা মোট বিতরণের ৯.৩৬ ভাগ।
একটি ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা মূল্যায়ন করা হয় তিনটি সূচকের উপর ভিত্তি করন।সূচক গুলো হলো খেলাপি ঋণের পরিমান,প্রভিশন সংরক্ষণ ও মূলধনের পরিমাণ। যে সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেশি, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধনের স্বল্পতা রয়েছে সে সব ব্যাংক বেশি সংকটে আছে। এই তিনটি সূচকের আরও অবনতি হলে ব্যাংক গুলো দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।
যে সব ব্যাংক বেশি সংকটে রয়েছে
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ৬ টি ব্যাংক অধিক ঋণ খেলাপি, প্রভিশন ঘাটতি ও মূলধন ঘাটতিতে বেশি ভুগছে। অগ্রনী,জনতা,বেসিক,রুপালী,ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক এই ৬ টি ব্যাংকে তিনটি সূচকের অবনতি চরম পর্যায়ে রয়েছে। আরও দেখুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং জব ইন্টারভিউ | ইন্টারভিউর প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেবেন
সবচেয়ে বেশি ঋণ খেলাপিতে রয়েছে সরকারি খাতে পরিচালিত জনতা ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থ বছরের সেপ্টেমবর পর্যন্ত এই ব্যাংকের ঋণ খেলাপির পরিমাণ দাঁড়ায় ২০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতির দিকে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।এই ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা। অপর দিকে প্রভিশন ঘাটতিতে এগিয়ে আছে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ন্যাশনাল ব্যাংক। এই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে প্রায় ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা।
প্রভিশন ঘাটতির দিক দিয়ে এগিয়ে আছে বেসিক, অগ্রণী, জনতা, রুপালী, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, মিউচুয়্যাল ট্রাস্ট, ন্যাশনাল ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। বেসিক ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ৪ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা। যা সরকারি ভাবে পরিচালিত ব্যাংক গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি।এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৫২১ কোটি টাকা, রুপালী ব্যাংকের ৩ হাজার ১৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংক গুলোর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। এই ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৭ হাজার ৪৭৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। এছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩৪৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ১৪৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ছাড়াও অগ্রণী, রুপালী, জনতা, সোনালী, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক, ন্যাশনাল, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও পদ্মা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ বাংকের তথ্য অনুযায়ী অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৮৫১ কোটি টাকা। রুপালী ব্যাংকের ২ হাজার ৩৯০ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আরও দেখুনঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং কি | সেলস এবং মার্কেটিং এর মধ্যে পার্থক্য
বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকি ভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে জমা রাখতে হয়। এই পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে না পারলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দুর্বল ব্যাংক মূল্যায়নের অন্যতম সূচক হলো প্রভিশন সংরক্ষণ হার। ব্যাংক যখন ঋণ দেয় তার বিপরীতে ঋণ গ্রহীতার নিকট হতে নিদিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) হিসেবে জমা রাখে। কোনো ঋণ খেলাপি হলে ব্যাংক যাতে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে না পড়ে তার জন্যই এই প্রভিশন জমা রাখার বিধান রয়েছে। ঋণের ধরণ অনুসারে প্রভিশনের হার আলাদা হয়ে থাকে। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ০.২৫ থেকে ৫ শতাংশ, সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ ও কু ঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন রাখতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে এই আর্থিক বছরের ১ম তিন মাস পরে রাস্ট্রয়ত্ত চার ব্যাংক ও বেসরকারি চার ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ১৯ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা।
দেউলিয়া ব্যাংক তালিকা ২০২৩
উপরে বর্ণিত সূচকের আলোকে আমরা কয়েকটি ব্যাংকের তালিকা করতে পারি যে সব ব্যাংক খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছে ও ভবিষ্যতে দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যাংক গুলো হলোঃ
- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
- বেসিক ব্যাংক
- বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক
- বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্যাংক
- জনতা ব্যাংক
- পদ্মা ব্যাংক
- আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক
- রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
ব্যাংক গুলোর সংকট মোকাবেলায় করনীয়
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অনিয়ম, দুর্নীতি ও যোগসাজেশের মাধ্যমে অধিকাংশ ঋণ বিতরণ করায় ঋণের একটা বড় অংশ খেলাপি হয়ে পড়ছে। আবার প্রদত্ত ঋণের বিপরীতে ব্যাংক গুলোকে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে ফলে মূলধন ঘাটতিতে পড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হতে না পারলে প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি আরও বাড়বে। সমস্যা আরও বাড়বে। এই জন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলেই খেলাপি ঋণ পরিশোধ হবে। তিনি মনে করেন, “খেলাপি ঋণ কমাতে হলে সবার আগে ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনতে হবে। গ্রাহকের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সক্ষমতা দেখে ঋণ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকে শক্ত হতে হবে। কোনো হস্তক্ষেপে ঋণ দিলে তা খেলাপি হবেই।” আরও দেখুনঃ সামাজিক কার্যক্রম কি
ঋণ খাতের দুর্বলতা শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে জরুরী ভিত্তিতে একটি কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশন ব্যাংক খাতের দুর্বলতা চিহ্নিত করে এগুলো রোধে স্বাধীনভাবে কাজ করবে। খেলাপি ঋণ কমাতে না পারলে ব্যাংকের প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি রোধ করা সম্ভব হবে না। আর খেলাপি ঋণ হ্রাস করার জন্য অর্থনীতিবিদদের মতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা একান্ত জরুরী। আসুন আমরা পদক্ষেপ গুলো জেনে নিই।
১। ব্যাংক গুলোকে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যাংক পরিচালকদের হাত থেকে প্রভাব মুক্ত রাখা।
২। খেলাপি ঋণ বিষয়ক আলাদা করে মনিটরিং সেল গঠন করা।
৩। যথেষ্ট যাচাই বাছাই করে ঋণ প্রদান ও ঝুঁকি পূর্ণ ঋণ প্রদানে বিরত থাকা।
৪। ঋণ প্রদানে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বন্ধ করা।
৫। সুশাসন নিশ্চিত করা।
৬। খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের কালো তালিকা প্রকাশ করা ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৭। ঋণের বিপরীতে যতাযথভাবে জামানত নেওয়া।
৮। একই খাতে বেশি ঋণ না দিয়ে বিভিন্ন খাতে ঋণ প্রদান করা।
উপরোক্ত পদক্ষেপ গুলো সঠিক ভাবে প্রয়োগ করতে পারলে খেলাপি ঋণের পরিমান কমানো সম্ভব বলে অনেকেই মনে করেন। আর খেলাপি ঋণ কমলে ব্যাংক গুলোর প্রভিশন ও মূলধন ঘাটতি রোধ করা সম্ভব হবে।
আমানত কারীর ঝুঁকি কতটুকু
যে সব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি প্রবল সেই সব ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানত অনেক ঝুঁকিতে রয়েছে। এই বিষয়ে অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, “যে সব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হবে, ধরে নিতে হবে সেই সব ব্যাংকের গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আর যে ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে পড়বে, ধরে নিতে হবে সেই ব্যাংকই ঝুঁকিতে রয়েছে।
তাই আমরা বলতে পারি যে সব ব্যাংক সঠিক ভাবে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে পারবে তাদের গ্রাহকদের আমানত সুরক্ষিত থাকবে। এর ব্যতিক্রম হলে গ্রাহকের আমানত ঝুঁকিতে পড়বে। আমরা বিশ্বাস করি ব্যাংক গুলো দ্রুতই তাদের সংকট মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে এবং দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং সাথে সাথে গ্রাহকদের আস্থা ও বিশ্বাস বজায় রাখবে।
তবে কেউ কেউ এই সুযোগে কিছু বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যে ব্যাংকে টাকা জমা রাখলে তা ফেরত পাওয়া যাবেনা, ব্যাংক বিলুপ্তি হয়ে যাবে ইত্যাদি। তাই সবাইকে এই সব কথায় কান না দিয়ে সচেতন থাকার অনুরোধ করা হলো।