সহিষ্ণুতার মূল্য রচনা- সংকেত: ভূমিকা; সহিষ্ণুতা কী; সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্য; সহিষ্ণুতার মূল্য; সহিষ্ণুতার উদাহরণ; সহিষ্ণুতা শিক্ষায় পিতা-মাতার ভূমিকা; ছাত্র জীবনে সহিষ্ণুতার চর্চা; অসহিষ্ণুতার কুফল; দুর্বলতা নয় সহিষ্ণুতা; উপসংহার।
সহিষ্ণুতার মূল্য রচনা
ভূমিকাঃ
‘ধৈর্য বিষের মতো মনে হয়,
পরে কিন্তু তার ফল বেশ মধুময়’।
-শেখ সাদী
যে মহৎ গুণ মানব জীবনকে সফল, সার্থক, সাহসী ও বিজয়ী হওয়ার পথ দেখায় তা হলো সহিষ্ণুতা। এটি দুঃখ ও সংসার জীবনের নানা প্রতিকূলতাকে জয় করার মূলমন্ত্র। সহিষ্ণুতার গুণেই মানুষ সব অন্যায় অত্যাচারকে পরাজিত করে। যে মানুষ সহনশীল হয় নানা বাঁধা বিপত্তি পার হয়ে শেষ পর্যন্ত জয়মাল্য তাঁর ললাটেই জোটে। তাই ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবনে উন্নতি ও শান্তি বজায় রাখার জন্যে সহিষ্ণুতার কোনো বিকল্প নেই। কারণ সহিষ্ণুতার গুণেই মানব সভ্যতা মহিমান্বিত হয়েছে। মানুষ হয়েছে সৃষ্টির সেরা জীব।
সহিষ্ণুতা কীঃ
সহ্য করার মানসিকতাকেই সহিষ্ণুতা বলে। অর্থাৎ নিজের ক্ষমতা ও ঔদ্ধত্য প্রকাশ না করে, নম্রতা ও সৌজন্যের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করাই সহিষ্ণুতা। সহিষ্ণুতা শেখায় নিজের মতকে বিশ্বাসের পাশাপাশি অন্যের বিরোধী মতের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হওয়া।
সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্যঃ মানবজীবনের অন্যতম মহৎগুণ সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতার বৈশিষ্ট্যাবলী নিম্নরূপঃ
* যেকোনো পরিস্থিতিতে সহনশীল মনোভাব প্রদর্শন করা; স্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
* বিরোধীমতকে শ্রদ্ধা করা, দমনপীড়নের মাধ্যমে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা না করে বরং যুক্তিতর্ক দিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্ট করে তোলা।
* প্রতিপক্ষের উগ্র মনোভাব, আক্রমণাত্মক ও বিদ্বেষপূর্ণ মনোবৃত্তির পরিপ্রেক্ষিতেও নিজেকে সংযত রাখা, ধৈর্য ধারণ করা, প্রতিপক্ষের প্রতি প্রতিশোধপরায়ণ না হওয়া।
* সহনশীল ব্যক্তি মাত্রেই অপরের ঔদ্ধত্যকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে সহিষ্ণুতার মাধ্যমেই ধৈর্য, ক্ষমা ও মহত্ত্বের পরিচয় প্রকাশ পায়।
সহিষ্ণুতার মূল্যঃ
মানব জীবনে সহিষ্ণুতার মূল্য অপরিসীম। এই মহৎ গুণটির প্রয়োজনীয়তার শেষ নেই। পারিবারিক জীবনে শান্তি ও সংহতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে সহিষ্ণুতার ভূমিকা অতুলনীয়। আমাদের সংসারে নৈরাশ্যের বেদনা, ভয় ও বিপদ আছে। পরাজয়ের দুঃসহ গ্লানি ও শোক দুঃখের হৃদয়বিদারক আঘাত আছে। এখানে দুঃখ, বিপদ, লাঞ্ছনা, অপমানও আছে। এসব প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে সহিষ্ণুতার মাধ্যমেই লড়াই করতে হয়। কারণ টমসন বলেন- ‘আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে ভয় পাওয়া উচিত নয়। মেঘ ভেসে যাবেই।’ তাই যে পরিবারে সহিষ্ণুতা চর্চা করা হয়, সে পরিবার হয় সুন্দর। সেখানে ছেলেমেয়ে-আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে গড়ে ওঠে মায়ার বন্ধন ও প্রীতির সম্পর্ক।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
অসহিষ্ণু মানুষ সমাজ জীবনেও অনাকাঙ্ক্ষিত। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের সবার সাথে তাকে সুসম্পর্ক বজায় রেখে পথ চলতে হয়। কিন্তু সমাজের সব মানুষের চিন্তা-চেতনা এক রকম নয়। সামাজিক জীবনে বহু কারণে পরস্পরের সাথে বিরোধিতা দেখা দেয়। কখনো ভুল বোঝাবোঝি থেকে বিরোধীতা চরম রূপ নিতে পারে। এসব প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্যে মানুষকে ধীরস্থির ও ধৈর্য ধরে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হয়। অন্যথায় বড় ধরণের ভুল হয়ে যেতে পারে যার জন্যে যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়। তাই পারস্পরিক বিরোধের কল্যাণকর সমাধান ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য সহনশীলতা মহৌষধ হিসেবে কাজ করে। প্লুটাস বলেন- ধৈর্য হচ্ছে সমস্ত দুঃখ যন্ত্রণার একমাত্র প্রতিকার।’ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে ঘায়েল না করে বরং সহিষ্ণুতার মাধ্যমে তাদেরকে সহযোগিতা করলে বিরোধ এড়ানো যায়। সহিষ্ণুতায় তুমুল শত্রুও বন্ধুতে পরিণত হতে পারে। তাই সাফল্যের মূলমন্ত্র সহনশীলতার মাঝেই নিহিত। পরমতসহিষ্ণুতার অভাব জীবনকে ধ্বংস ও সর্বনাশের দিকে নিয়ে যায়। কারণ সহিষ্ণুতার অভাবই মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, দেশে দেশে বৈরী সম্পর্ক তৈরি করে। সাম্প্রদায়িকতার বীজবপন করে, সমাজে সৃষ্টি হয় দুর্নীতি ও অরাজকতা। মানুষ তার মহৎ গুণ সহিষ্ণুতার বলেই এই পৃথিবীতে যুগের পর যুগ ধরে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামাল দিচ্ছে এবং জীবন যুদ্ধে জয়ী হয়েছে। এখানেই মানবজীবনের গৌরব ও সার্থকতা।
সহিষ্ণুতার উদাহরণঃ
বিশ্বের যা কিছু আবিষ্কার, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, দুঃসাহসিক অভিযান সবই সহিষ্ণুতার আর্শীবাদে সম্ভব হয়েছে। যুগে যুগে মহামানব, প্রতিভাবান ও দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন প্রতি পদে, প্রতিটি কর্মে। তাদের চলার পথে এসেছে নানা-বাধা বিপত্তি। অকুতোভয়, দুঃসাহসী এসব মহামানবেরা গরল পেয়ালার বদলে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন অমৃতের পাত্র। হযরত মুহাম্মদ (স.) আরবের সমাজ থেকে পাপাচার দূর করার জন্য সত্য ও ন্যায়ের পথে মানুষকে আসার আহবান জানালে সেসব জ্ঞানহীন মানুষরা রক্ত ঝরায় তার সেই পবিত্র শরীর থেকে। কিন্তু তারপরও মুহাম্মদ (স.) থেমে যাননি। সহিষ্ণুতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন এদেরকে অভিশাপ না দিয়ে। তিনি বলেছেন- ‘এদের জ্ঞান দাও প্রভু, এদের ক্ষমা কর।’ কারণ তিনি জানতেন, আজ যারা সঠিক পথ গ্রহণ করছে না তাদের অনাগত সন্তানরাই একদিন এ পথে আসবে। একইভাবে, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক যীশু খ্রিস্ট ও গৌতম বুদ্ধও সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে রেখে গেছেন অতুলনীয় সহিষ্ণুতার নিদর্শন। যুগে যুগে সাহিত্য-শিল্প-বিজ্ঞান-সাধনায়ও মানুষ সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জীবনে শত দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও সাহিত্য সাধনা করেছেন। বিজ্ঞানী নিউটন, আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, মাইকেল ফ্যারাডে, লুই পাস্তুর, মাদাম কুরী -এসব বড় বড় বিজ্ঞানীদেরকেও বারবার সহিষ্ণুতার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে। মাইকেল এঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি এরা যেন সহিষ্ণুতার মূর্ত প্রতীক। যুগে যুগে কত অভিযাত্রী মৃত্যুর তোয়াক্কা না করে আবিষ্কার করেছেন নতুন নতুন দেশ। জয় করেছেন দুর্গম পাহাড় পর্বত, সাগর তলে খুঁজেছেন মণি-মুক্তা। সহিষ্ণুতাই তাদেরকে দুঃসাহসী অভিযানে প্রেরণা যুগিয়েছে। আর তাদের সহনশীলতা মানুষের কাছে হয়েছে আদর্শ। প্রবাদে আছে- ‘যে সহে সে রহে।’
আরও পড়ুনঃ রচনা
সহিষ্ণুতা শিক্ষায় পিতা-মাতার ভূমিকাঃ
ছেলে মেয়েরা মূলত বাবা মাকেই ছোটবেলায় বেশি অনুসরণ করে। বাবা-মা সন্তানকে প্রথম শেখায় কিভাবে অন্যের মতকে গুরুত্ব দিতে হয়, বিরোধী পক্ষকে শক্তি দিয়ে নয় বরং সহিষ্ণুতার মাধ্যমে জয় করতে হয়। ভন ডে বলেন- ‘মা তার সন্তানকে প্রথমে ধৈর্য ধরতে শেখাবেন।’ সন্তানরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মা-বাবা কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তা দেখে এবং এখান থেকেই সে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধৈর্য ধারণ ও ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কৌশল রপ্ত করে। তাই সন্তানকে সহনশীলতা শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার ভূমিকাই মূখ্য।
ছাত্রজীবনে সহিষ্ণুতার চর্চাঃ
ছাত্ররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এ সময়েই ছাত্রদের সহিষ্ণুতার চর্চা ও বিকাশ ঘটানোর উত্তম সময়। নির্ধারিত পাঠ্য বইয়ের বাইরে সহিষ্ণুতার শিক্ষার সুযোগ করতে শিক্ষকদের খেয়াল রাখা উচিত। কারণ আগামী দিনে এ শিক্ষা থেকেই তাঁরা ধৈর্য ধরে ও স্থিরচিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যেকোনো সমস্যাকে মোকাবিলা করার জন্যে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন- ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি।’
অসহিষ্ণুতার কুফলঃ
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সর্বত্র যে অশান্তি ও যুদ্ধ বিগ্রহ লেগে আছে তার মূলে আছে অসহিষ্ণুতা। এর কারণে নানা সমস্যার তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। অসহিষ্ণুতার একটি অন্যতম ফল হলো সাম্প্রদায়িক ভাবনার উদয়। এর ফলে সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুদেরকে নির্যাতন করার সুযোগ পাচ্ছে। অনেক সময় অসহিষ্ণুতার ফলে একান্ত আপন জনের মধ্যেও বিভেদ তৈরি হয়, সৃষ্টি হয় বৈরী সম্পর্ক। ক্ষমতার মোহে মানুষ কান্ড জ্ঞান হারিয়ে হয়ে ওঠে বেপরোয়া। আর মারাত্মক সব ভুল সিদ্ধান্ত ও সর্বনাশের দিকে নিজ পরিবার, সমাজ এবং কখনো রাষ্ট্রকেও ঠেলে দেয়। উইলিয়াম রাসেল বলেন- ‘অসহিষ্ণু লোকদের জীবনের বিড়ম্বনা কখনও কমে না।’ পরমত সহিষ্ণুতার অভাব দিন দিন বাড়তে থাকলে এ পৃথিবী অচিরেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে।
দুর্বলতা নয় সহিষ্ণুতাঃ
দুর্বলতা কখনোই সহিষ্ণুতা নয়। চোখের সামনে অত্যাচার-অবিচার দেখেও প্রতিবাদ না করা দুর্বলতা। যা কাপুরুষতারই নামান্তর। সহিষ্ণুতা কখনোই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় না। সহিষ্ণুতা মানুষ্যত্বকে বড় করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-
‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে।’
উপসংহারঃ
সহিষ্ণুতা মানবজীবনের সেরা গুণ যা জীবনকে সার্থক, সফল ও বিজয়ী করে তুলতে পারে। সংসার জীবনের নানা সংকটকে দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতার মাধ্যমে মোকাবিলা করে সঠিক সমাধান নিয়ে আসে। সহিষ্ণুতার চর্চাই পারে মাটির পৃথিবীতে স্বর্গপুরী রচনা করতে। পারে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে এক সুঁতায় গাঁথতে। সহিষ্ণুতার মাঝেই ধৈর্য, ক্ষমা ও মহত্ত্বের পরিচয় নিহিত।