বিশ্বশান্তি রচনা সংকেত: সূচনা; বিশ্বশান্তি ধারণার জন্ম; বিশ্ব পরিস্থিতির পট পরিবর্তন; বিজ্ঞান ও আধুনিক সমরাস্ত্রের ভয়াবহতা; বিশ্বশান্তির পক্ষে কবি; সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের কলমযুদ্ধ; চলচ্চিত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিশ্বশান্তি; জাতিসংঘ ও এর আন্দোলন; বৈশ্বিক বাস্তবতা; উপসংহার।
বিশ্বশান্তি রচনা
সূচনাঃ
মানুষ সহজাতভাবে শান্তিকামী। শান্তির খোঁজে একদিন যাযাবর মানুষ সভ্যতার গোড়াপত্তন করে। স্থিতিশীলতা ও প্রকৃতির অপার সম্ভাবনায় মানব সভ্যতা ক্রমেই সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু এ সমৃদ্ধি ধীরে ধীরে মানব মন ও সমাজকে জটিল করে তোলে। জন্ম নেয় শ্রেণি সংগ্রাম, দ্বন্দ্ব, লোভ-লালসার। মানুষ সমাজ ও রাষ্ট্র তৈরি করে আর মানব সভ্যতাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত করতে জন্ম দেয় নিয়মনীতি ও ক্ষমতাবান শাসক শ্রেণির। আর সাথে সাথে শুরু হয়ে যায় শোষণ, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ধ্বংসের খেলা। এ খেলা এখনও বিদ্যমান। এক বিংশ শতাব্দিতে এসেও আমাদের এর বিভীষিকা ও ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়। কারণ মানব মনের লোভ, প্রতিহিংসা, অজ্ঞতা এ খেলার সৃষ্টি করেছে, যা মানব সভ্যতার অস্তিত্বের সাথে মিশে আছে। এ সভ্যতার বেদীতল তাই বারবার রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। সংঘর্ষ ও যুদ্ধ বিনাশ করেছে কোটি মানুষের জীবন ও স্বপ্ন। তাই বিশ্বের লাখো কোটি মানুষের মুখে আজ শান্তির বাণী উচ্চারিত হচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
বিশ্বশান্তি ধারণার জন্মঃ
সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ যুদ্ধ সংঘর্ষে লিপ্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে, যুদ্ধ ছিল শুধু অস্তিত্ব বা বেঁচে থাকার লড়াই। পরবর্তীতে যুদ্ধ হতো সীমানা ও সম্পদ বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। পরে রাষ্ট্রভাবনার জন্ম হওয়ার পর রাষ্ট্র দখল ও আধিপত্য বিস্তারের জন্য যুদ্ধ শুরু হয়। বিগত শতকে বিজ্ঞান ও সভ্যতার অভূতপূর্ব উন্নতি, মানুষকে ভয়াবহ ও বিধ্বংসী যুদ্ধের দিকে আরও একধাপ অগ্রসর করে, শুরু হয় মহাযুদ্ধ। মহাযুদ্ধের হিংস্রতা মানুষের ধারণাকে বদলে দেয়। এরপরই ভাবতে হয় বিশ্বশান্তির ভাবনা। সহজ কথায়, বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বশান্তি ধারণার জনক।
বিশ্ব পরিস্থিতির পট পরিবর্তনঃ
প্রথম মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন এমন এক সংগঠন তৈরির ধারণা দেন যা দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করবে। এই প্রথম তখন বৈশ্বিক শান্তির ধারণার উদ্ভব ঘটে। এ লক্ষ্যে লীগ অব নেশনস গঠিত হয়। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনা সমঝোতার অভাবে এটি ভেঙ্গে যায়। এটিই বিশ্বের প্রথম সংগঠন যার মূল লক্ষ্য ছিল বিশ্বশান্তি স্থাপন করা। লীগ অব নেশনসের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। মহাযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সমরাস্ত্রের বিকাশ তথা পারমানবিক শক্তির উদ্ভাবন মানব সভ্যতার ইতিহাসকে বদলে দেয়। ১৯৪৫ সালে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকি শহরকে পারমানবিক বোমার আঘাতে ধ্বংস করে দেয়।
এ অস্ত্রের ভয়াল আক্রমনের প্রমান আজও শহর দুটো এবং শহরের মানুষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে বেড়াচ্ছে। এ হামলা প্রমান করে আমাদের মানবসভ্যতার সংকট কতোটা ভয়ঙ্কর। মানুষ আজ নিজেদের হিংস্রতায় নিজেরাই বিমূঢ়। তাই, বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ু যুদ্ধের সময়ে পারমানবিক অস্ত্রের বিকাশ ঘটলেও এর ভয়াবহতার কথা চিন্তা করে প্রয়োগ হয়নি। যদিও এখন মানুষের এ ধ্বংসের ক্ষমতা বহুগুনে বেড়েছে, বিশ্ব শক্তিগুলো আরও শক্তিশালী হয়েছে, তবুও এ অস্ত্রের প্রয়োগ এখনও হয়নি। যেকোনো সময়ে প্রতিহিংসার মূল্য মানব সভ্যতাকে দিতে হতে পারে। বিশ্ব নাগরিকরা তাই আজ সচেতন। তাদের আন্দোলন, প্রতিবাদ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরও সুগঠিত করেছে। কোনো রাজ্য জয় নয়, কোনো ক্ষমতার আধিপত্য নয়, তারা চায় বিশ্বশান্তি। তাদের এ চিন্তাধারা বিশ্ব রাজনীতির রচিত পথ পাল্টে দিয়েছে। রাষ্ট্রনায়কেরা আজ নতুনভাবে বিশ্বশান্তির গুরুত্ব দিচ্ছেন।
আরও পড়ুনঃ রচনা
বিজ্ঞান ও আধুনিক সমারাস্ত্রের ভয়াবহতাঃ
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার মানব সভ্যতাকে এক দিক থেকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কাগজে-কলমে ভয়ানক সমারাস্ত্রের বিরোধী, কিন্তু বাস্তবে এর ভয়াবহতার শিকার হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের দূর্বল রাষ্ট্রগুলো। পারমানবিক শক্তির অধিকার বলে অনেক বড় রাষ্ট্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর মধ্যে বৈদেশিক নীতি ও স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা বাড়াচ্ছে, সামরিক খাতে দেশগুলোর ব্যয়বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, ভারত এ খাতে অর্থ ব্যয় করেছে।
দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন, আনবিক যুদ্ধ জাহাজ বানাচ্ছে, নক্ষত্র যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে মার্কিন মুলুকে। যুদ্ধ গ্রহে-উপগ্রহে, মহাকাশে বিস্তার লাভ করেছে। লেজার রশ্মি দিয়ে শত্রুর উপগ্রহ কিভাবে ধ্বংস করা যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছে সমরবিদরা। এসব মারনাস্ত্র চালাতে যে শক্তি ও জ্বালানি দরকার তা সংগ্রহের জন্য বিশ্ব অবলোপন করছে আরও সংঘাত। ২০০৩ সালে তেলের জন্য আমেরিকার ইরাক আক্রমন, লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশুর মৃত্যুর কারণ। যেখানে গোটা বিশ্ব আজ ক্ষুধা, দারিদ্র্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত, সেখানে বিশ্ব শক্তিগুলো তান্ডব চালাচ্ছে যা শুধু মাত্র তুচ্ছ স্বার্থ ও ক্ষমতার জন্য। এর ফলে ঝরে যাচ্ছে হাজারো নিষ্পাপ প্রাণ।
বিশ্বশান্তির পক্ষে কবি-সাহিত্যিকদের কলম যুদ্ধঃ
শিল্প, সাহিত্যকে সমাজের র্দপন বলা হয়। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখনীর মাধ্যমে সমাজের রূপ ও ইতিহাসকে তুলে ধরেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমরা আমাদের সভ্যতাকে তাদের লেখনীর মাধ্যমেই চিনি। যুদ্ধের ভয়াবহতা, বিশ্বশান্তি বার্তা আমরা তাদের সৃষ্টিকর্মের মাঝে খুঁেজ পাই। পাবলো পিকাসোর শ্বেত শুভ্র পারাবত আজ দেশে দেশে হাজারে হাজারে নীল গগণে ডানা মেলে উড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলেই শান্তির দাবি সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। গঠিত হয়েছিল “যুদ্ধ ও ফ্যাসিবিরোধী সংঘ”। অনেক চিত্রকর্ম ও সাহিত্য রচনা হয়েছে বিশ্বশান্তির বানী প্রচারের জন্য।
চলচ্চিত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিশ্বশান্তিঃ
বিশ্বশান্তি কথাটিকে বিশ্বব্যাপি জনপ্রিয় করার পেছনে, চলচ্চিত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। এই একবিংশ শতাব্দিতে সংবাদ টিভি গুলো যেমন- আল-জাজিরা, বিবিসি সারাবিশ্বের শান্তি কার্যক্রমের খবর ঢালাওভাবে প্রচার করছে। তাছাড়া নানা মিশনের পক্ষে-বিপক্ষে টকশো ও সেমিনারের আয়োজন করেছে। বিশ্বশান্তি সম্পর্কে রাষ্ট্রনায়কদের মতামত নিচ্ছে। পত্র-পত্রিকা ও অনলাইন মাধ্যমগুলোতে সংবাদ ও তথ্য প্রচারের মাধ্যম বিশ্বশান্তির পক্ষে মিডিয়া চাপ তৈরি করছে। স্ট্যানলি কুবরিক এর দি পাথ অব গ্লোরি, রবার্তো বেনিগনি এর লাইফ ইজ বিউটিফুল সহ অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যুদ্ধ ও সংঘর্ষের উপরে। আমাদের বাংলাদেশেও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে “জয়যাত্রা, গেরিলা” সহ নানা চলচ্চিত্র হয়েছে। আর বার বার বিশ্ব নাগরিককে শান্তি আনয়নের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
জাতিসংঘ ও এর আন্দোলনঃ
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে বিশ্বশান্তির উদ্দেশ্যে। এর নির্দিষ্ট নীতিমালা ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী আছে। ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি বিবাদপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তি আনয়নের মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। কঙ্গো, সুদানে রিফিউজি সমস্যা সমাধান, বিশ্বসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রন, আফগানিস্থান-পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে সামরিক অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব জাতিসংঘের। তাছাড়া বিশ্বশান্তি আনয়নে ক্ষুদ্র দেশগুলো নানা দাবী-দাওয়া জাতিসংঘের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে। বিশ্ব শক্তিগুলো ব্যপক অনুদানের শক্তি বলে জাতিসংঘ তথা সারাবিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করছে। যা বিশ্বশান্তি আনয়নে প্রধান বাধা।
বৈশিক বাস্তবতাঃ
আমরা সকলেই বিশ্বশান্তির প্রয়োজনীয়তায় অনুধাবন করি। বিশ্বশান্তি রক্ষার জন্য আমাদের কী কী করনীয় তাও আমরা জানি। কিন্তু এখনও আমরা চিন্তা ও জ্ঞানের জগতে মুক্ত নই, উদার নই। আমাদের অজ্ঞতা ও হীনম্মন্যতা অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দাসে পরিণত করে রেখেছে। বিশ্বশান্তির পথে বাধাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
– বিশ্বায়নের অপব্যবহার,
– আন্তর্জাতিক সংঘের অপব্যবহার,
– ক্ষমতার আগ্রাসন,
– দারিদ্র্য,
– অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা,
– সন্ত্রাস ও বিশ্বব্যপী সামাজিক অস্থিতিশীলতা,
– মরণাস্তের উত্তরোত্তর বিকাশ,
– মানব মনের পঙ্গুত্ব ও দাসত্ব,
– বিশ্বশক্তির আধিপত্য ইত্যাদি।
উপসংহারঃ
আমাদের সব বাধা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ, সংঘাত মানেই মৃত্যু, উপবাস, দুর্ভিক্ষ। মানুষের তিলে তিলে গড়ে তোলা সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখ থেকে তুলে আনতে বিশ্বের কোটি কোটি জনতা আজ জেগে উঠেছে। সবাইকে এক কাতারে দাঁড়াতে হবে, ঐক্যের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করতে হবে। উপরে ফেলতে হবে আগ্রাসন ও দাসত্বের কালো থাবা। বর্বরতার দংশন থেকে সভ্যতাকে বাঁচাতে হবে। মানবিক বিপ্লবের মাধ্যমে শান্তির স্তম্ভকে মজবুত করতে হবে।