ভবিষ্যৎ আর্থিক স্বচ্ছলতার কথা আমরা সকলেই চিন্তা করি এবং তার জন্য অর্থ সঞ্চয় বা কোথাও বিনিয়োগের কথা ভাবি যেখান থেকে আমরা মুনাফা করতে পারি। আপনি যদি ব্যবসায়িক ঝুঁকি এড়িয়ে নিশ্চিত মুনাফার জন্য বিনিয়োগ করতে চান তবে আপনার জন্য ফিক্সড ডিপোজিট হবে সেরা পছন্দ। কারণ ব্যবসায় বা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করলে মুনাফা হতে পারে আবার নাও হতে পারে। কিন্তু ফিক্সড ডিপোজিট করলে আপনি নিশ্চিতভাবেই মুনাফাসহ বিনিয়োগের অর্থ একটি নির্দিষ্ট সময় পর ফেরত পাবেন। তাই আমরা আজ আপনাদের জানানোর চেষ্টা করব ফিক্সড ডিপোজিট কি, এর সুবিধা কি, কোথায় ফিক্সড ডিপোজিট করা লাভজনক হবে, আপনি সর্ব নিম্ন কত টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করতে পারবেন ও মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রয়োজনে কিভাবে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গতে পারবেন। আরও দেখুনঃ দুর্বল ব্যাংকের তালিকা | দুর্বল ব্যাংক ২০২৩

ফিক্সড ডিপোজিট কি

ফিক্সড ডিপোজিট কি

ফিক্সড ডিপোজিট করার আগে আমাদের সকলের আগে এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। ফিক্সড ডিপোজিট বা স্থায়ী আমানত হলো এক প্রকার বিনিয়োগ। ব্যাংক বা অন্য কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখা এবং মেয়াদ শেষে আসল অর্থের সাথে কিছু সুদ বা মুনাফা প্রাপ্তিকেই ফিক্সড ডিপোজিট বলে। সঞ্চয়ী হিসাবের চাইতে এই হিসাবে টাকা রাখলে ব্যাংক আপনাকে বেশি সুদ/মুনাফা দিবে। 

ফিক্সড ডিপোজিটে মেয়াদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গা যায় না, আবার ভাঙ্গা গেলেও আপনি সম্পূর্ণ সুদ পাবেন না। তবে আপনি আপনার পছন্দ মত মেয়াদে টাকা জমা রাখতে পারবেন। অনেক ব্যাংক এখন ১ মাসের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করার সুবিধা দিচ্ছে। আপনি ৩ মাস, ৬ মাস, ১ বছর বা ৩ বছর বা তার বেশি মেয়াদের জন্যও ফিক্সড ডিপোজিট করতে পারবেন। সাধারণত মেয়াদ যত বেশি হবে আপনার সুদের হার তত বেশি হবে। কোনো কোনো ব্যাংক ৮%-৯% হারে সুদ দিচ্ছে। আরও দেখুনঃ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো কি কি

আপনি মেয়াদ শেষে মুনাফা সহ সকল অর্থ ফেরত নিতে পারবেন। আবার চাইলে শুধু মুনাফা নিয়ে আবার নতুন মেয়াদে ফিক্সড ডিপোজিট করতে পারবেন। তাই যাদের অলস অর্থ পরে আছে বা যারা ব্যবসায়িক ঝুঁকি নিতে ভয় পাচ্ছেন তাদের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করা হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। 

ফিক্সড ডিপোজিট করার কিছু সুবিধা

ফিক্সড ডিপোজিট করার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মুনাফা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা। অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করলে মুনাফা নাও হতে পারে। কিন্তু এই খাতে বিনিয়োগ করলে আপনার মুনাফা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। ঝুঁকি মুক্ত বিনিয়োগ খাত হিসেবে ফিক্সড ডিপোজিট সকলের নিকট জনপ্রিয়। ফিক্সড ডিপোজিট এর আরও কিছু সুবিধা নিচে উল্লেখ করা হলো।

  • অন্যান্য আমানতে চাইতে স্থায়ী আমানতের সুদের হার বেশি।
  • ফিক্সড ডিপোজিটের জমার বিপরীতে ঋণ পাওয়ার সুবিধা।
  • যে কোনো সময় ডিপোজিট ভেঙ্গে জমা টাকা ফেরত নেওয়া যায়।
  • স্থায়ী আমানত গ্রাহকদের জন্য অনেক ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড প্রদান করে। 
  • নিশ্চিত মুনাফা প্রাপ্তি।
  • ঝুকিমুক্ত বিনিয়োগ।

যেখানে ফিক্সড ডিপোজিট করা বেশি লাভজনক

দেশের প্রায় সকল ব্যাংকেই ফিক্সড ডিপোজিট করা যায়। আবার বাংলাদেশ পোস্ট অফিসেও করা যায়। তবে ব্যাংকের চাইতে এখানে সুদের হার কম। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের তুলনায় কিছু বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক বেশি সুদ দিয়ে থাকে। ফিক্সড ডিপোজিটের মেয়াদ বেশি হলে ঢাকা ব্যাংক ৮% হারে সুদ দিয়ে থাকে। অন্যন্য ব্যাংকও প্রায় একই হারে সুদ দিয়ে থাকে। আরও দেখুনঃ সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ডিপিএস | সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ডিপিএস তালিকা

তবে আপনি যদি ইসলামিক মন মানসিকতার হোন এবং সুদ থেকে দূরে থাকতে চান তবে আপনার জন্য ইসলামীক ব্যাংক গুলোতে ফিক্সড ডিপোজিট করা উপযুক্ত হবে। এই সকল ব্যাংকের মুনাফার হারও অনেক ভালো। দেশে প্রচলিত ইসলামীক ব্যাংক গুলোর মধ্যে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বেশি মুনাফা দিয়ে থাকে। তাই আপনি আপনার অর্থ দেখে শুনে সেরা ব্যাংকেই বিনিয়োগ করবেন এটাই আমাদের কাম্য।

অনেক ব্যাংক সর্ব নিম্ন ১ মাসের জন্যও ফিক্সড ডিপোজিট করার সুবিধা দিচ্ছে। এতে করা আপনি অল্প মেয়াদের জন্য টাকা জমা রেখেই মুনাফা ভোগ করতে পারবেন। আবার বর্তমানে অনেক ব্যাংক ১০০ দিনের জন্য একটা ফিক্সড ডিপোজিট করার ব্যবস্থা করেছে। এই মেয়াদ শেষে ইচ্ছা করলে আপনি সব অর্থ ফেরত নিতে পারবেন আবার ইচ্ছা করলে নতুন মেয়াদের জন্য ডিপোজিট করতে পারবেন।

দীর্ঘ মেয়াদে ফিক্সড ডিপোজিট করার অসুবিধা হলো মেয়াদ শেষে আপনি টাকা ফেরত নিলে বা ডিপোজিট ভেঙ্গে ফেললে আপনি অনেক কম সুদ পাবেন। অনেক সময় টাকার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। তাই স্বল্প মেয়াদের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করায় উত্তম।

সর্ব নিম্ন যত টাকার ফিক্সড ডিপোজিট করা যায়

আপনি কমপক্ষে ১০,০০০ টাকা দিয়ে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করতে পারবেন। এর কম টাকা দিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট করা যায় না। তবে ব্যাংক ও মেয়াদ ভিত্তিতে এর পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। দেশের কিছু ব্যাংক যেমন সিটি ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করতে গেলে আপনাকে কমপক্ষে ৫০,০০০ টাকা জমা করতে হবে। আবার ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক গুলোতে আপনি ১০,০০০ টাকা দিয়েই ফিক্সড ডিপোজিট করতে পারবেন। তাই ব্যাংক ভেদে ডিপোজিটের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। তবে আপনি যত বেশি অর্থ দিয়ে ফিক্সড ডিপোজিট করবেন আপনার সুদ/মুনাফা প্রাপ্তির হারও তত বেশি হবে। আরও দেখুনঃ সমিতির নামকরণ | নতুন সমবায় সমিতির নাম

ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গার নিয়ম

ফিক্সড করার সময় খুব সতর্কতার সাথে ডিপোজিটের মেয়াদ নির্বাচন করতে হয়। বেশি সুদের আশায় কোনো কিছু না ভেবে দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ডিপোজিট করলে অনেক তা মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ভেঙ্গে ফেলার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। যাদের কয়েক মাস বা বছর পর পর একবারে বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় তাদের দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করা উচিত নয়। 

মেয়াদ পূর্তির আগে ডিপোজিট ভাঙ্গার অনুমতি সকল ব্যাংক দেয়না। যে সব ব্যাংক এই অনুমতি দেয় তারা আপনাকে ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য যে সুদ নির্ধারিত ছিল তা না দিয়ে সঞ্চয়ী হিসাবের সুদ অনুযায়ী আপনাকে মুনাফা প্রদান করবে। আবার অনেক ব্যাংক চলতি হিসাবের সুদ অনুযায়ী আবার অনেক ব্যাংক কোনো সুদ প্রদান করে না। ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙ্গার জন্য আপনাকে সর্ব প্রথম ব্যাংক ম্যানেজার বরাবর একটি আবেদন করতে হবে এবং কি কারণে ভাঙ্গতে চাচ্ছেন তা উল্লেখ করতে হবে।

ফিক্সড ডিপোজিট এর সুদের হার  সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। অনেকে ডিপোজিটের মেয়াদ শেষে একবারে মুনাফাসহ আসল ফেরত নেয়। আবার অনেকে প্রতি মাসে বা ৩ মাস পর পর সুদ/মুনাফা গ্রহণ করে থাকে। এই দুই ক্ষেত্রের জন্য ডিপোজিট ভাঙ্গার পর সুদ প্রাপ্তির জন্য আলাদা নিয়ম রয়েছে। 

ধরুন আপনি ৫ বছরের জন্য টাকা রেখেছেন। কিন্তু ১ বা ২ বছর পর তা ভেঙ্গে ফেলতে চাচ্ছেন। তবে আপনাকে ব্যাংক সঞ্চয়ী বা চলতি আমানতের যে সুদ তা প্রদান করবে। আপনি যদি ১ বছর পর টাকা ফেরত নেন তবে আপনি ১ বছরের জন্য সঞ্চয়ী বা চলতি আমানতে টাকা রাখলে যে সুদ পাইতেন তাই পাবেন। তবে তিন বছর বা চার বছর পর টাকা ফেরত নিলে আপনি ৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ী আমানতের সুদ ও বাকি সময়ের জন্য সঞ্চয়ী বা চলতি আমানতের সুদ পাবেন। আরও দেখুনঃ দুর্বল ব্যাংকের তালিকা | দুর্বল ব্যাংক ২০২৩

আবার যারা প্রতি মাসে স্থায়ী আমানতের সুদ গ্রহণ করে থাকে তাদের ক্ষেত্রে হিসাবটা একটু আলাদা হয়ে থাকে। ধরুন আপনি ৭ বছরে জন্য স্থায়ী আমানত করেছেন এবং প্রতি মাসে এই হিসাবে সুদ গ্রহণ করছেন। কিন্তু ২ বা ৩ বছর আপনার টাকার প্রয়োজন হলো এবং ডিপজিট ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নিলেন। এক্ষেত্রে আপনি সঞ্চয়ী বা চলতি আমানতের সুদ হিসেবেই মুনাফা পাবেন। তবে আপনি যে মাসে স্থায়ী আমানতের সুদ নিয়েছেন সেই অর্থ আপনার আসলের অর্থ থেকে সমন্বয় করা হবে। অর্থাৎ আপনি যে টুকু স্থায়ী আমানতের সুদ গ্রহন করেছেন ব্যাংক তা আপনার কাছে থেকে নিয়ে নিবে। 

এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক চার্জ কেটে নিয়ে ব্যাংক আপনাকে আপনার আসল অর্থ ফেরত দিবে। তাই ফিক্সড ডিপোজিট করার আগে অবশ্যই আপনাকে মেয়াদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করতে হবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙ্গে ফেললে আপনি কাঙ্ক্ষিত মুনাফা করতে পারবেন না। তাই আপনাদের উচিত মেয়াদ শেষ করে টাকা ফেরত নেওয়া। তাই দীর্ঘ মেয়াদে ফিক্সড ডিপোজিট করার তুলনায় স্বল্প মেয়াদে ডিপোজিট করায় উত্তম। 

পরিশেষে বলতে চাই, যারা নিশ্চিত মুনাফার আশায় টাকা বিনিয়োগ করতে চান তাদের জন্য ফিক্সড ডিপোজিট করায় হবে সবচেয়ে সেরা বিনিয়োগ খাত।

Google News