দিন বদলের বাংলাদেশ রচনা- সংকেত: ভূমিকা; দিন বদলের বাংলাদেশ; খাদ্য নিরাপত্তা ও বৈদেশিক ঋণ; কৃষি ক্ষেত্রে দিন বদল; শিক্ষা ক্ষেত্রে দিন বদল; শিল্প ও অর্থনীতি; বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দিনবদল; আইনের শাসন ও নারীর ক্ষমতায়ন; দিন বদলে সরকারি উদ্যোগ; দিন বদলে সফলতা; সমস্যা ও সম্ভাবনা; দিন বদলে আমাদের করণীয়; উপসংহার।
দিন বদলের বাংলাদেশ রচনা
ভূমিকা:
পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। রক্তক্ষয়ী নানা আন্দোলন সংগ্রামের পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে অভ্যুদয় ঘটেছে বাংলাদেশের। দীর্ঘ প্রায় দুশো বছর বৃটিশ ও চব্বিশ বছর পাকিস্তানি শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে চলেছে নানা সংগ্রাম-আন্দোলন। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। দীর্ঘ শাসন ও শোষণেও বাংলাদেশ থেমে থাকেনি। স্বাধীনতার চার দশকে এগিয়ে চলেছে নিরন্তর। অর্জন করেছে নানা লক্ষ্যমাত্রা, সৃষ্টি করেছে বিস্ময়। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, হতে চলেছে আত্মনির্ভর। স্বপ্ন দেখছে দিন বদলের, সমৃদ্ধতর এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের।
দিন বদলের বাংলাদেশ:
বাংলাদেশ স্বাধীনতার চার দশকের প্রতি দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা এবং উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন, অলাভজনক উন্নয়ন উদ্যোগ বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পে বাংলাদেশ বিশ্বের মডেল হয়ে আছে। শুধু তাই নয় চিকিৎসা, খাদ্য নিরাপত্তা ও রপ্তানিতে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিচ্ছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি ঘটেছে। শিক্ষার হার ৬৫% ছাড়িয়ে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দিন দিন কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে গবেষকরা মনে করেন বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে।
খাদ্য নিরাপত্তা ও বৈদেশিক ঋণ:
কোনো দেশের উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে তার খাদ্য নিরাপত্তা, রপ্তানি ও বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের অনুপাতের উপর। বর্তমানে খাদ্যশস্যসহ ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈদেশিক ঋণের উপর নির্ভরতা কমছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান গ্রহণের পরিমাণ ছিল ২১২৬ মিলিয়ন ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা ছিল ১,৮০০ মিলিয়ন ডলার। জিডিপির অনুপাত অনুযায়ী বৈদেশিক ঋণ অনুদান এখন ২ শতাংশেরও নীচে নেমে গেছে। রপ্তানি আয় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ তে ১৯.৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
কৃষি ক্ষেত্রে দিনবদল:
কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে গেছে। এটা ১৫ বছর আগেও কল্পনা করা যেত না। কৃষি ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতি ছেড়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নত জাতের বীজ তৈরি করা হচ্ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড শস্যের চাষাবাদ ও আধুনিক সেচ প্রকল্প শস্য উৎপাদনকে বাড়িয়ে দিয়েছে। কৃষির উন্নতিতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। বহুমুখী চাষাবাদ বিশেষ করে শাক্্সবজি উৎপাদন বেড়ে গিয়েছে কল্পনাতীতভাবে। বাংলাদেশ আজ কৃষিতে আত্মনির্ভরশীল। কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি করা হচ্ছে। সর্বোপরি কৃষির আধুনিকায়নের ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
শিক্ষা ক্ষেত্রে দিনবদল:
শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আধুনিকায়নের ছোঁয়া বাংলাদেশকে তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক এগিয়ে দিয়েছে। শিক্ষার আধুনিকায়নের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। নারী শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য উপবৃত্তি ও খাবার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দেশে নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বেতন মওকুফ ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষিতের হার প্রায় ৭০% এ উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার পর এ হার ছিল ২০%। বর্তমানে দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রায় ৯০ হাজার। মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রায় ১৯০০০, কলেজ প্রায় ৩৫০০, মাদ্রাসা প্রায় ৯৫০০, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট প্রায় ১৯৫টি। [সূত্র- বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০১১]
শিল্প ও অর্থনীতি:
বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে দিনবদল ঘটেছে। স্বাধীনতার সময় জিডিপিতে যেখানে শিল্প খাতের অবদান ছিল প্রায় ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩১.৯১ শতাংশে (২০১২-১৩)। বিশেষ করে পোশাক শিল্প, চামড়া শিল্প, হিমায়িত খাদ্য ও মৎস্য শিল্প, পাট ও পাটজাত দ্রব্য ইত্যাদি শিল্পে বাংলাদেশ ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে। দেশের রপ্তানি আয় দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমানে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হার ১৬.৫ শতাংশেরও বেশী। ১৯৭২-৭৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০ মার্কিন ডলার। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা হয় ৯২৩ মার্কিন ডলার, বর্তমানে তা ১০৪৪ ছাড়িয়েছে (২০১৪ চলতি)। একই অর্থবছরে মোট জিডিপি ছিল ৭ হাজার ১২ কোটি টাকা কিন্তু বর্তমানে তা প্রায় ৪ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে [অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩]। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় মোট দুই হাজার ২২৪ কোটি ২৬ লাখ ডলার। যা গত বছরের ১৩ শতাংশ বেশি। মোট রপ্তানি আয়ের ৮১ শতাংশ পোশাক খাত থেকে এসেছে।
আরও পড়ুনঃ রচনা
বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দিনবদল:
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে। দেশে বিজ্ঞান শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষাকে বিজ্ঞানমুখী করে তোলা হচ্ছে। বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সুনামও অর্জন করেছে। পাটের জিন রহস্য আবিষ্কার, মহিষের জিন রহস্য আবিষ্কার, নানা ইলেকট্রনিক পণ্য এবং বিশেষ করে ওষুধ শিল্পে বাংলাদেশ আজ গর্বিত সুনামের অধিকারী। স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের অগ্রগতি ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আইনের শাসন ও নারীর ক্ষমতায়ন:
মৌলিক অধিকার, সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, বিচার ব্যবস্থা ও আইন শৃঙ্খলা, সুষ্ঠু গণতন্ত্র তথা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সংসদে নারী প্রতিনিধি রয়েছে ২০ শতাংশ। সংসদে নারী প্রতিনিধিত্বে বাংলাদেশ বিশ্বের ১৪৮ দেশের মধ্যে ৭৪ তম। এভাবে দিন বদলের চেতনায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
দিন বদলে সরকারি উদ্যোগ:
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ও স্বাধীনতার অঙ্গীকার নিয়ে গড়তে সরকার কতগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অতীতের সব ব্যর্থতা ভুলে সংঘাতময় রাজনীতিকে পেছনে ফেলে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য -নিরক্ষরতা, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের অভিশাপমুক্ত উন্নত সুন্দর ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে বর্তমান সরকার দৃঢ় প্রত্যয়ী। এ প্রত্যয়ে বর্তমান সরকার রূপকল্প ভিশন ২০২১ অনুযায়ী কতিপয় লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যেমন- ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ করা, বাংলাদেশকে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করা, নিরক্ষরতা দূর, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত এবং প্রতি বাড়িতে বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা। এছাড়াও শিশু মৃত্যুর হার রোধ, নারীর ক্ষমতায়ন এবং ২০২১ সালের মধ্যে গড় আয়ষ্কাল ৭০ এ উন্নীত করা ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তাছাড়া সরকার দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্নীতিরোধ, সুশাসন ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের উন্নয়ন, শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিল্প ও বাণিজ্যের প্রসার, গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা নিশ্চিত, শক্তিশালী প্রতিরক্ষা, সাংস্কৃতিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও উদ্যোগ এবং নারী শিক্ষার প্রসার ও সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে যাচ্ছে।
দিনবদলে সফলতা, সমস্যা ও সম্ভাবনা:
নতুন শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে পড়তে হচ্ছে নানা সমস্যায়। এসব সমস্যা কাটিয়ে নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সফল হয়ে নজর কেড়েছে। তবে এত কিছু সত্ত্বেও দেশে বেকার সমস্যা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। কলুষিত ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের রাজনীতির চর্চা করছে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ। দুর্নীতি ও অব্যবস্থার কারণে অর্থনৈতিক দুর্বলতা, সমাজ জীবনে আইন শৃঙ্খলার অবনতি, শিক্ষাজগতে নৈরাজ্য এবং সমাজ সেবার নামে নিজের স্বার্থ হাসিল ও স্বেচ্ছাচারিতার চর্চা চলছে। এই সংস্কৃতি যুব সমাজকে বিপথগামী করছে। বর্তমানে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব সমস্যার সমাধান করা। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ এবং বাঙালি জাতি বীরের জাতি। কোনো বাধাই এদের কাছে বাধা নয়। তাই এতে সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমরা স্বপ্ন দেখি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।
দিন বদলে আমাদের করণীয়:
পৃথিবী বদলে যাচ্ছে। এর সাথে পৃথিবীর মানুষ ও তার স্বপ্নের পরিবর্তন হচ্ছে। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে আমাদেরও বদলে যেতে হবে। সবরকম ভেদাভেদ, হানাহানি সংকীর্ণতা ভুলে স্বার্থহীনভাবে দেশ গড়ার কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের ১৬ কোটি জনগণের ৩২ কোটি হাত। এই হাতকে প্রশিক্ষিত করে কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য চাই সৎ, যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব এবং সুশাসন। তা হলেই সমাজে সুখ আসবে, সমৃদ্ধি আসবে। দিন বদল হবে সমাজের, মানুষের, বাংলাদেশের।
উপসংহার:
দিন বদলের পালায় স্বাধীন বাংলাদেশের জীবনমান ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এক জায়গায় থেমে নেই। অসীম সম্ভাবনার দেশ উন্নতির দিকেই এগুচ্ছে ধীরে ধীরে। এ সম্ভাবনাকে এতদিন সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি। পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কাজে লাগানো হলে বাংলাদেশ হয়তো আরো এগিয়ে যেত। অনেক আগেই দিনবদল হত। তাই দিন বদলের চেষ্টায় ভবিষ্যতে একটি উন্নত ও আধুনিক গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।