তারেকের বাংলাদেশ ব্যাংকে দ্বিতীয় হওয়ার গল্প


মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষায় ‘সহকারী পরিচালক’ পদে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। তার বাবা মো. আব্দুল্লাহ ফারুক ব্যবসায়ী ও মা হাজেরা বেগম গৃহিণী। তারেক খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতক পাস করেন।

বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সহকারী পরিচালক’ পদে কর্মরত। সম্প্রতি ব্যাংকে চাকরি পাওয়া, নতুনদের পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ স্বপ্ন নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

আরো দেখুনঃ অনুপ্রেরণার গল্প

আপনার পড়াশোনা সম্পর্কে বলুন—
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: আমার জন্ম ফেনীতে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সেখানেই পড়াশোনা করেছি। তারপর ঢাকায় চলে আসি এবং খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সেখান থেকে এসএসসি পাস করে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করি। পরে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করি।

আপনার শৈশবের দিনগুলো কেমন কেটেছে?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: স্কুলজীবন থেকেই আমি লেখাপড়ার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। নিয়মিত খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, কুইজ প্রতিযোগিতা, কুরআন তেলাওয়াতের মতো কার্যক্রমে অংশ নিতাম। সহশিক্ষা কার্যক্রম আমাকে কিছুটা হলেও সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এসেও আমি বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। শাবিপ্রবির খেলাধুলা বিষয়ক সংগঠন ‘স্পোর্টস সাস্ট’র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। এ ছাড়া শীতবস্ত্র সংগ্রহ, রক্তদান কর্মসূচি, চ্যারিটি শো আয়োজন—এসব কাজে খুব উৎসাহ ছিল। এসব কাজ করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি, যা পরে আমার আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছে। আমার মনে হয়, নিজের ওপর বিশ্বাস থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: পড়াশোনায় তেমন প্রতিবন্ধকতা টের পাইনি মা-বাবার জন্য। বাবা-মা কষ্ট করে হলেও আমাদের পড়াশোনার জন্য নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। তবে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পরে নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করা ও পড়াশোনার ব্যাপারে নিজের কৌশল ঠিক করাটা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল।

আরও দেখুনঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েও ভর্তি হতে না পারা ছেলেটি এখন বিসিএস ক্যাডার!

বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি স্নাতক পাস করি। ২০১৯ সালের শুরু থেকেই সরকারি চাকরির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি। মূলত তখন থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক সম্পর্কে অনেক ইতিবাচক তথ্য জানতে পারি। বাংলাদেশ ব্যাংকে কাজের পরিবেশ ভালো, উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে ও দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যায়—এসব আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সে সময় থেকেই আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির স্বপ্ন দেখি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির প্রস্তুতির গল্প শুনতে চাই—
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: স্নাতক পাসের পর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে এমবিএ করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি, যা পরে সরকারি চাকরির পরীক্ষার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। চাকরির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে গণিত ও ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে আমি বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় অংশ নিতে থাকি। ২০২০ সালে সোনালী ব্যাংকে অফিসার পদে যোগদান করি। আমার বাবা-মা ঢাকায় বসবাস করলেও আমার পদায়ন ছিল নোয়াখালীতে। এর মাঝে করোনা মহামারি শুরু হয়। একই সঙ্গে চাকরি করে পড়াশোনা করা ও কর্মস্থল থেকে দূরে থাকায় মা-বাবার খেয়াল রাখতে খুব কম সময় পেতাম।

বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরির ভূতটা তখনো আমার মাথা থেকে যায়নি। সেজন্য অফিস থেকে ফেরার পর যতটুকু সময় পেতাম পড়াশোনার সঙ্গে যোগাযোগটা ধরে রাখার চেষ্টা করতাম। তবে একটা সময় আমি অনুভব করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো তুমুল প্রতিযোগিতামূলক চাকরির পরীক্ষায় উতরে যেতে হলে পড়াশোনায় আরও মনোনিবেশ করতে হবে। তাই ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কঠিন সিদ্ধান্ত নিই।

তখন অনেকেই নিরুৎসাহিত করলেও মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, কাছের বন্ধু-বান্ধব সাহস দিয়েছেন। পরে ঢাকায় এসে আবার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। পরে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে সহকারী পরিচালক এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হই। আমি মনে করি, চাকরি ছেড়ে নতুন করে প্রস্তুতি নেওয়ার চ্যালেঞ্জটাই ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল। এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল পড়াশোনাটা উপভোগ করা। সে সময় চাকরির চেয়েও আমি পড়াশোনাটা বেশি উপভোগ করতাম। পড়াশোনাটা নিজের উপভোগ্য উপায়ে করা গেলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়।

পর্দার আড়াল থেকে কারা অনুপ্রেরণা দিয়েছেন?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: করোনা মহামারির সময় চাকরির বাজারের অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। অথচ তখন আমি সোনালী ব্যাংকের মতো একটি বড় প্রতিষ্ঠানের অফিসার পদে কর্মরত। কিন্তু আমার স্বপ্নপূরণের জন্য চাকরি ছাড়তে হয়। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আমার মা-বাবা অনেক সাহস দিয়েছেন। তারা সব সময় আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। পাশাপাশি পড়াশোনার ব্যাঘাত যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে তারা সব সময় লক্ষ্য রেখেছেন। বাবা-মায়ের কথাই সেজন্য সবার আগে বলতে হবে।

ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া কি কোনোভাবে কাজে লেগেছে?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: চাকরির ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেও অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে চাকরির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ, গ্রুপ স্ট্যাডি করার সুযোগ পেয়েছি। ফেসবুকে বিভিন্ন চাকরির বিষয়ক গ্রুপ আছে। চাকরির বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে প্রস্তুতি, প্রশ্নের ধরন বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে তথ্য পেয়েছি। সেগুলো দেখেও অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। তবে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে দূরে থেকে পড়াশোনা করেন। আমি এটা করিনি। কারণ সোশ্যাল মিডিয়া থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও সাম্প্রতিক তথ্য পাওয়া যায়। চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ন্ত্রিত উপায়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে হবে।

ব্যাংকে চাকরির ক্ষেত্রে পড়াশোনা নিয়ে নতুনদের জন্য কী পরামর্শ থাকবে?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: ব্যাংকের প্রিলিমিনারিতে সাধারণত বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ব্যাকরণ, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞান, আইসিটি বিষয়ে ৮০টি বা ১০০টি নৈর্ব্যত্তিক প্রশ্ন থাকে। বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ব্যাকরণ; এ অংশে সাধারণত ব্যাকরণ থেকেই বেশি প্রশ্ন থাকে। ব্যাকরণের জন্য নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ পাঠ্যবই পড়তে হবে। তবে শব্দভান্ডার, সমার্থক শব্দ, বিপরীত শব্দ, বাংলা বানানের নিয়ম, বাগধারা, বাক্য সংকোচন—এসব অন্য বই থেকেও অনুশীলন করতে হবে। বাংলা সাহিত্য অংশের জন্য প্রাচীনযুগ, মধ্যযুগ সম্পর্কে ও আধুনিক যুগের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের সম্পর্কে জানতে হবে।

ইংরেজির প্রস্তুতিকে ভোকাব্যুলারি ও ইংলিশ গ্রামার—এই দুইভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভোকাব্যুলারি চর্চা করার জন্য কোনো একটি বই থেকে শব্দের অর্থ জানার পাশাপাশি ইন্টারনেটে শব্দ সম্পর্কে সার্চ করে শেখাটা কার্যকর হতে পারে। নতুন শব্দ দিয়ে বাক্যগঠন, সেটার সিনোনিম, অ্যানটোনিম জানা ও তা নোট করে রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর গ্রামার অংশের সেনটেন্স কারেকশন, ইরোর ডিটেকশন, সেনটেন্স কমপ্লেশনের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে। পাশাপাশি বাজারে প্রচলিত বই, বিগত বছরের প্রশ্নসমূহ ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে নমুনা প্রশ্ন দেখে চর্চা করতে হবে। ইংরেজি পত্রিকা থেকে নিবন্ধ পড়ার অভ্যাস ইংরেজির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য খুবই কার্যকর।

গণিতের প্রস্তুতি শুরু করা যেতে পারে অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির বই থেকে বিষয়ভিত্তিক অঙ্ক করার মাধ্যমে। তারপর অন্যান্য বই ও ওয়েবসাইট থেকে চর্চা করা উচিত। শতকরা, লাভ-ক্ষতি, কাজ, সময়-গতি, বয়স, নাম্বার সিস্টেম, মিশ্রণ, বিন্যাস-সমাবেশ, সম্ভাব্যতা, সেট, গড়, পরিমিতি, জ্যামিতি—এসব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অঙ্ক করার সময় শর্ট-কাট নিয়ম না খুঁজে বোঝার দিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একটি অঙ্ক একাধিক নিয়মে করার চেষ্টা করতে হবে।

সাধারণ জ্ঞানের জন্য বাজারে প্রচলিত যে কোনো বই থেকে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী খুব ভালো করে পড়তে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত পত্রিকা পড়তে হবে ও প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নোট করে রাখতে হবে। এ পদ্ধতি সাম্প্রতিক বিষয়াবলীতে নিখুঁত প্রস্তুতির জন্য অত্যাবশ্যক। এ ছাড়াও আইসিটির ওপর ধারণা রাখতে হবে। এখান থেকেও প্রশ্ন আসে।

ব্যাংকের জন্য লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি সম্পর্কে কিছু বলুন—
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: লিখিত পরীক্ষায় ২০০ নম্বরের জন্য গণিত, বাংলা ও ইংরেজি রচনা, প্যাসেজ, ট্রান্সলেশন, সামারি রাইটিং, লেটার রাইটিং—এসব নিয়েই প্রশ্ন থাকে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক ও ব্যাংক বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান পড়ে যেতে হবে। লিখিত পরীক্ষায় ভালো করতে হলে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের বিকল্প নেই। সংবাদপত্র থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর তথ্য নোট করে রাখা খুবই কার্যকর।

ব্যাংকের ভাইভা প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: ভাইভায় ২৫ নম্বর বরাদ্দ থাকে। মৌখিক পরীক্ষার প্রস্তুতি অনেকখানি ব্যক্তিকেন্দ্রীক। নিজের সম্পর্কে, পঠিত বিষয় সম্পর্কে, নিজ জেলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শখ সম্পর্কে প্রশ্ন হতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংক, ব্যাংকিং সেক্টর, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, দেশের অর্থনীতি, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রস্তুতি আবশ্যক। এ ছাড়া সাম্প্রতিক দেশ-বিদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি সম্পর্কে জেনে যেতে হবে। নমুনা ভাইভা পড়েও ধারণা লাভ করা যায়। মৌখিক পরীক্ষায় অবশ্যই পরিপাটি পোশাক পরিধান করে যেতে হবে ও ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকার হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. তারেক বিন আব্দুল্লাহ: নিজের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া, বিভিন্ন বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার ইচ্ছে আছে। নিজেকে দক্ষ একজন সেন্ট্রাল ব্যাংকার হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করবো।

তথ্যসূএঃ জাগো নিউজ

Google News