বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রচনা সংকেত: ভূমিকা; শিক্ষা কি; শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা; বাংলাদেশে শিক্ষার চিত্র; জাতীয় শিক্ষানীতি; বর্তমানে দেশে শিক্ষার মান; বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট; শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট সমাধানের উপায় ও আমাদের করণীয়; উপসংহার।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা রচনা
ভূমিকাঃ
Education is the backbone of a nation. মানুষের মেরুদন্ডের মতো শিক্ষাও একটি জাতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ হিসেবে পরিগণিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে জাতি এগিয়ে যায়, উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সন্তোষজনক চিত্র আমাদের চোখে পড়ে না। তবে আশার বিষয় হচ্ছেÑ শিক্ষা পদ্ধতি, শিক্ষার মান, শিক্ষানীতি, শিক্ষার জন্য বরাদ্দ, শিক্ষার পরিবেশ প্রভৃতির উন্নয়নে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
শিক্ষা কিঃ
শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ Education-যা ল্যাটিন শব্দ Educere বা Educatum থেকে এসেছে। মানুষের সত্যিকারের পরিচয় তার মনুষ্যত্ব ও যোগ্যতার মধ্যে। মানব সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই একজন পরিপূর্ণ মানুষের সব গুণ তার মধ্যে বিকশিত হয়ে ওঠে না। এসব গুণাবলী তাকে নিজের সাধনায় অর্জন করতে হয়। এই যোগ্যতা বা গুণবালী অর্জনের জন্য মানুষকে বিভিন্ন উৎস থেকে যে জ্ঞান অর্জন কতে হয় তাই শিক্ষা। শিক্ষা হলো-‘The harmonious development of body, mind and soul.’ অর্থাৎ মানুষের মানবিক, দৈহিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণের ধারাবাহিক পদ্ধতি হলো শিক্ষা।
শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাঃ
ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। একমাত্র শিক্ষার মাধ্যমেই বাস্তব জীবনে চরম উৎকর্ষতা লাভ করা সম্ভব হয়। জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে শিক্ষার বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগে জীবনকে উৎকর্ষমন্ডিত করা যায়। বিশ্বের বহুমুখী জ্ঞানভান্ডারের সাথে শিক্ষার মাধ্যমেই পরিচিত হওয়া যায়। অজানাকে জানা এবং সেই জানাকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার কৌশল শিক্ষার মাধ্যমেই সম্ভব। সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ, যোগ্যতা ও মনুষ্যত্ব অর্জন এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত হয়ে তা থেকে জীবনকে উপকৃত করার মাধ্যমে হলো শিক্ষা। সর্বোপরি, জীবনকে সাফল্যমন্ডিত, সৌন্দর্যমন্ডিত, অর্থবহ ও কৃতকার্য করার জন্য শিক্ষাই একান্ত ও মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
বাংলাদেশে শিক্ষার চিত্রঃ
বাংলাদেশে সাক্ষরতার শতকরা হার ৫১.৮% (আদমশুমারি ২০১১)। ২০১৫ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করা সরকারের অঙ্গীকার। ইতোমধ্যে ৯৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। ৩১ হাজার ২০৮টি সরকারি, রেজিস্টার্ড ও কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩-৫ বছর বয়সী শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা হয়েছে। সরকারি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৬৩ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বছরে প্রায় ৭৮ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত সবার জন্য বিানমূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে। দেশের জিডিপির ১.৬ ভাগ ব্যয় হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে আর সরকারি সার্বিক ব্যয়ের মাত্র ১৫ ভাগ বরাদ্দ এই ক্ষেত্রের উন্নয়নে।
জাতীয় শিক্ষানীতিঃ
২০১০ সালের ৩১ মে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ মন্ত্রিসভায় অনুমোদন লাভ করে। এ শিক্ষানীতিতে মোট আটাশটি অধ্যায় ও দুটি সংযোজনী রয়েছে। এ শিক্ষানীতিতে কিছু নতুন বিষয় সংযোজিত হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক, সার্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করা । প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে প্রাথমিক শিক্ষাস্তর ধরা হয়েছে এই শিক্ষানীতিতে। এছাড়াও-
– ৫ বছরের শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার (১ বছরের জন্য) ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
– প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে পঞ্চম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে দশম শ্রেণিতে বৃত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
– নতুন শিক্ষানীতির আলোকে প্রচলিত ডিগ্রি (পাস) কোর্স ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে ৪ বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স চালু রাখা হচ্ছে।
– শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত শিক্ষাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বর্তমানে দেশে শিক্ষার মানঃ
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে দেশে শিক্ষাব্যবস্থা সম্প্রসারণশীল হলেও শিক্ষার গুণগত মানের ক্রমাগত অবনতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রচুর পরিমাণে বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠায় শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও মান নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক উভয় পর্যায়ে শিক্ষাদান ও শিক্ষাগ্রহণে যোগ্যতার অভাব রয়েছে। লেখাপড়ায় দীনতা ও আসামঞ্জস্যতা থাকায় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় পাস করে যেনতেনভাবে ডিগ্রি অর্জনের জন্য অবৈধ পন্থা অবলম্বন করছে। শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, পাসের হার বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার গুণগত মান কমেছে ও বাস্তবমুখী শিক্ষার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
আরও পড়ুনঃ রচনা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকটঃ
বাংলাদেশে সাক্ষরতার শতকরা হার মাত্র ৫১.৮% হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বহুমুখী সংকট রয়েছে। নিম্নে শিক্ষাব্যবস্থার সংকটগুলো সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরা হলো-
যুগোপযোগী শিক্ষার অভাবঃ
বর্তমান যুগকে বিশ্বায়নের যুগ বলা হয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা প্রযুক্তিনির্ভর না হওয়ায় বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। যা আমাদেরকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থাঃ
বাংলাদেশের সংবিধানে জনগণের জন্য একটি সর্বজনীন, গণমুখী এবং বৈষম্যহীন শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গীকার করা হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাদানের গুণগত মান, বিদ্যালয় পরিচালনার ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ের উপকরণাদি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাস্তবমুখী শিক্ষানীতির অভাবঃ
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭২ সালের ‘কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ থেকে বর্তমান পর্যন্ত বেশ কিছু শিক্ষানীতি প্রবর্তন করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয়, দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে দরকার সুনির্দিষ্ট যুগোপযোগী শিক্ষানীতি যা আজও প্রকৃত অর্থে প্রণীত হয়নি।
মুখস্থনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থাঃ
ব্যবহারিক শিক্ষার সুযোগ কম থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্থনির্ভর শিক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে। যদিও মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বর্তমানে সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ে এখনো মুখস্ত বিদ্যাই ভরসা।
ইংরেজি শিক্ষার প্রতি অনীহাঃ
বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজি কেবল একটি ভাষার নাম নয় বরং এটি টেকনোলজির অপর নাম। কিন্তু মাদ্রাসা ও সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় নামসর্বস্ব ইংরেজি শেখানো হয় যা প্রয়োজনীয় ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণঃ
বর্তমানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি পাচ্ছে না। অন্যদিকে শিক্ষকগণ শিক্ষাদানের আদর্শ ভুলে কোচিং কিংবা বাসায় পড়িয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।
দক্ষ শিক্ষকের অভাবঃ
বর্তমান সরকার শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করলেও শিক্ষকদের জন্য তেমন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখছে না। ফলে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না।
শিক্ষকদের আন্দোলনঃ
বেতনভাতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বর্তমানে শিক্ষকরা আন্দোলনে রাস্তায় নামছে যা পড়াশুনার পরিবেশে ব্যাপক বিঘ্ন ঘটাচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসঃ
বর্তমানে শিক্ষা বিপর্যয়ের অন্যতম এরকটি কারণ হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। একটি বিশেষ মহলের সহায়তায় এই ঘৃণ্য অপরাধটি সংগঠিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রকৃত মেধার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। যা আমাদের উন্নয়নের পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।
ছাত্ররাজনীতি ও সন্ত্রাসঃ
বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি ও সন্ত্রাস অনুপ্রবেশ করায় পড়াশুনার পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। রাজনীতিতে ছাত্ররা ব্যবহৃত হচ্ছে, ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন আন্দোলনে শিক্ষাঙ্গন স্থবির হয়ে পড়ছে।
শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট সমাধানের উপায় ও আমাদের করণীয়ঃ
যে জাতি যতো বেশি শিক্ষিত, সে জাতি ততবেশি উন্নত। সুতরাং আমাদের সর্বাঙ্গীণ উনয়নের জন্য শিক্ষাব্যবস্থার সংকট উত্তরণ অপরিহার্য। তাই সরকারের পাশাপাশি আমাদের সকলেরই নৈতিক দায়িত্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমস্যামুক্ত করা। শিক্ষাব্যবস্থার সংকট সমাধান কল্পে আমাদের নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে-
– শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী, বিজ্ঞানসম্মত, কর্মমুখী, প্রযুক্তিনির্ভর ও বাস্তবসম্মত করতে হবে।
– শিক্ষাক্ষেত্রে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং যাবতীয় শিক্ষাবৈষম্য দূর করতে হবে।
– প্রযুক্তিনির্ভর বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে।
– শিক্ষাক্ষেত্রে যাতে পূর্ণমেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়, এজন্য মুখস্তনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে হবে।
– ইংরেজিকে শুধু বিদেশি ভাষা হিসেবে না দেখে বিশ্বায়নের জন্য অপরিহার্য ভাষা হিসেবে পরিগণিত করতে হবে।
– বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টার, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ বন্ধ করে শিক্ষার যথাযথ মান বজায় রাখতে হবে।
– শিক্ষকদেরকে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে এবং শিক্ষকদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
– শিক্ষা প্রশাসনকে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে।
– প্রশ্নপত্র ফাঁস কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশে সংকটমুক্ত একটি যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন এখন শুধু সময়ের দাবি। পদ্ধতি পরিবর্তন এবং প্রচলিত পদ্ধতিকে বাস্তবসম্মত ও দুর্নীতিমুক্ত করে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে হবে। বাংলাদেশের শিক্ষাকে গুণগত মানের দিক থেকে উন্নত করতে পারলেই জাতীয় জীবনে উন্নয়ন সম্ভব হবে।