বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার রচনা- সংকেত: ভূমিকা; বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ; বন্যা, ঘূণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস; নদী-ভাঙ্গন; ভূমিকম্প; খরা; দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা; বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবেলা ব্যবস্থা; উপসংহার।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার রচনা
ভূমিকা:
হাজার বছর ধরে প্রকৃতি ধারণ করে আসছে মানুষসহ প্রাণীজগতের সবার প্রয়োজনীয় রসদ। প্রকৃতিকে ব্যবহার করে জীবন সংগ্রামী মানুষ গড়ে তুলেছে সভ্যতা। প্রাণশক্তিতে ভরপুর মানুষ প্রকৃতিতে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজের আধিপত্য। প্রাণীজগতের এই আবাসস্থল পৃথিবীর প্রকৃতি বড়ই রহস্যময়। প্রকৃতি নিজের বুকে ধারণ করে আছে প্রানীজগতের বেঁচে থাকার সব উপাদান। আবার এই প্রকৃতিই খেয়ালবশে হয়ে ওঠে বৈরী, প্রমত্ত, উদ্ধত। আকস্মিক বিপর্যয়ে প্রকৃতি মুহূর্তের মধ্যেই তছনছ করে দেয় মানুষের সাজানো সংসার, স্থাপনা, সৌধ। আধুনিক পৃথিবী সভ্যতার চরম শিখরে পৌঁছে গেলেও প্রকৃতিকে এখনো মানুষ বশ মানাতে পারেনি। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এ যুগেও মানুষ অনেক সময় প্রকৃতির কাছে পুরোপুরি অসহায়। পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত করে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখানে নিয়মিত। এদেশের মানুষ তাই অনেকটা অভ্যস্ত এবং পরিচিত এসব দুর্যোগের সাথে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ নিচে বর্ণনা করা হলো-
বন্যা: প্লাবন বা বর্ষার ভয়াল রূপ হলো বন্যা। নদী-মাতৃক বাংলাদেশের বন্যা একটি অন্যতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে প্রচুর বৃষ্টিপাতের ফলে এদেশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। কখনো কখনো বন্যা ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেশের ব্যাপক জনপদকে প্লাবিত করে। বিগত পাঁচ দশক থেকে বন্যা বাংলাদেশের একটি বার্ষিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ১৯৫৪, ’৫৫ ও ’৬৪ সালের বন্যা এদেশের মানুষের মনে এখনো বিভীষিকা রূপে বিরাজমান। ১৯৭০ সালের বন্যা দেশের ব্যাপক অংশ প্লাবিত করে। ১৯৮৮ সালে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৩টি জেলাই বন্যা কবলিত হয়। এই বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ও দুর্ভোগ ছিল সীমাহীন। ১৯৯৮ সালের বন্যা ফসল হানি, প্রাণহানি, সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও স্থায়িত্বের দিক থেকে ছিল শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এই বন্যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, কৃষি, শিল্পখাতসহ অন্যান্য খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। ২০০৪ সালের বন্যায় ২২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। সরকারি হিসাব মতে এ বন্যায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকা।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস: বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড় এক ধরণের উষ্ণ কেন্দ্রিয় লঘুচাপ, যার চতুর্দিকে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস প্রচন্ডভাবে ঘুরতে থাকে। একটি পূর্ণাঙ্গ ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত হওয়ার সময় অতিক্রান্ত এলাকায় তিন ধরণের প্রভাব বিস্তার করে। ক) প্রবল বাতাস, খ) বন্যা ও গ) জলোচ্ছ্বাস। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রের পানি স্ফীত হয়ে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে উপকূলের কাছাকাছি যে উঁচু ঢেউয়ের সৃষ্টি করে তাকেই জলোচ্ছ্বাস বলা হয়। ঘূর্ণিঝড় উপকূল অতিক্রম করার সময় উঁচু জলোচ্ছ্বাস উপকূলবর্তী এলাকার অসংখ্য প্রাণহানি ও সম্পদের বিনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের উপর দিয়ে প্রবাহিত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ৫ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। ১৯৯১ সালে একই প্রাকৃতিক দুর্যোগে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে দেড় লাখ লোকের প্রাণহানি ঘটে, গৃহহীন হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। জলোচ্ছ্বাসের সময় খাদ্য, আসবাবপত্র ও অন্যান্য দ্রব্যাদি বানের জলে ভেসে যায়। গাছ-পালা উৎপাটিত হয়, জমির ফসল বিনষ্ট হয়, পশুপাখি প্রাণ হারায়, জলাশয় ও নলকূপের পানি দুষিত হয়ে জনজীবনের বিপর্যয় ডেকে আনে। ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি ঘূণিঝড় সিডর বাংলাদেশে মারাত্মক দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতে প্রায় এক হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। ছয় লক্ষ টনেরও বেশি ধান নষ্ট হয়, ছিয়ানব্বই হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস এবং একুশ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এছাড়া সুন্দরবনের অনেক প্রাণী মারা যায়। এছাড়া ২০০৯ সালের মে মাসে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয়া ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রায় দুই লক্ষ একর জমি লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। খুলনা, সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাণ হারায় প্রায় দুইশত মানুষ। ৮০টি পরিবারের প্রায় ৫০০ মানুষ হয় গৃহহীন।
নদী ভাঙ্গন: নদী-মাতৃক বাংলাদেশে অসংখ্য ছোট-বড় নদী জালের মতো বিস্তৃত হয়ে আছে। বর্ষা মৌসুমে প্রতিটি নদীই খরস্রোতা ও বেগবান হয়। নদীর চিরন্তন ধর্মই হলো একূল ভেঙে ওকূল গড়া। এ দেশের বড় বড় নদীসমূহ যেমন পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বর্ষা মৌসুমে ভয়ঙ্কর সর্বনাশা রূপ ধারণ করে। প্রতি বছরই নদীর ভাঙনে প্রচুর সম্পদ, স্থলভূমি ও জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী-ভাঙন এক সর্বনাশা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগে প্রতি বছরই বহুলোক ঘরবাড়ি, বসত-ভিটা, জমি-জমা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছে।
ভূমিকম্প: বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বড় ধরণের কোনো ভূমিকম্প হয়নি। তবে বহুবার হালকা কম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে এ কম্পন বিপদসীমা না পেরোলেও গবেষকগণ এ দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন। এখানে হালকা ভূমিকম্প এতো নিয়মিত হচ্ছে যে, যেকোনো সময় বড় ধরণের ভূমিকম্প হতেও পারে। এ সময়ে মানুষ তাই সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত সম্ভাব্য ভূমিকম্পের জন্য। কারণ এদেশের নগর পরিকল্পনা ও ভূমি মোটেও ভূমিকম্প প্রতিরোধসম্পন্ন নয়। একটু জোরে কম্পন হলেই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা চরমে পৌঁছে যাবে।
খরা: দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে, নদীবহুল হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিশাল এলাকা প্রতিবছর খরায় আক্রান্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। এর প্রভাবে প্রায় পুরো উত্তরাঞ্চলে সেচের অভাব পড়েছে। মাটিতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়াতে সেখানে মরুভূমির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। প্রতি বছরই বিপুল পরিমাণ ফসল নষ্ট হচ্ছে খরায়। এতে খাবারের প্রকট সংকট দেখা দিচ্ছে, মঙ্গায় মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ।
আরও পড়ুনঃ রচনা
দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা:
প্রাকৃতিক দুর্যোগের ব্যাপারে আমরা অনেকটা অসহায়। যেমন- ভূমিকম্প বা জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। কিন্তু যথাযথ পূর্বপ্রস্তুতি, উদ্ধার তৎপরতা ও দুর্যোগ পরবর্তী কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে আনা যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা কমানো ও ক্ষয়-ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য কিছু প্রস্তাবিত পদক্ষেপ হলো-
– অগভীর নদী ড্রেজিং করতে হবে।
– ঝুঁকিপূর্ণ নদীর তীরে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
– সম্ভাব্য দুর্যোগের ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে।
– যথাযথভাবে দুর্যোগ মোকাবেলার পরিকল্পনা করতে হবে।
– রাস্তাঘাট মজবুত করে বানাতে হবে।
– জনগণকে দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতন করে তুলতে হবে।
– দুর্যোগ পরবর্তী ত্রাণ দ্রুত ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছাতে হবে।
– প্রয়োজনীয় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে।
উপরের ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করা হলে দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমবে বলে আশা করা যায়। এসবের জন্য অবশ্যই জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলার পরিকল্পনা থাকতে হবে। সেই সাথে লাগবে আগাম প্রস্তুতি।
বাংলাদেশে দুর্যোগ মোকাবেলা ব্যাবস্থা:
প্রতি বছর ছোট-বড় দুর্যোগের সাথে লড়তে হয় বাংলাদেশকে। তাই এদেশে যথাযথ দুর্যোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো হলো:-
– ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা কর্ম পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছে। এতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা নির্ধারণ করা হয়েছে।
– নদী শাসনের মাধ্যমে বন্যা প্রতিরোধের জন্য Flood Action Plan প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যেখানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
– উপকূলীয় ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্পে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
– বহু সংখ্যক উপকূলীয় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে।
– উপকূলীয় বনায়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
– দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাজ সমন্বয় করার জন্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
– দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্যে ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে জনগণের সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে।
উপসংহার:
ভৌগোলিক অবস্থান এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জলবায়ুর কারণে বাংলাদেশে প্রতি বছরই কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। বর্তমানে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এড়াবার পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুর্যোগ মোকাবেলার দিকটিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগসমূহ পুরোপুরি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলেও এগুলো মোকাবেলার উপায় জানা থাকলেও জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।