বাংলাদেশের খাদ্য সংকট ও সমাধান রচনা- সংকেত: ভূমিকা; খাদ্য সমস্যার স্বরূপ; বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট; বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের কারণ; খাদ্য সংকট সমাধানের উপায়; সরকারি উদ্যোগ; উপসংহার।
বাংলাদেশের খাদ্য সংকট ও সমাধান রচনা
ভূমিকা:
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোকই কৃষিকাজের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। দেশের সিংহভাগ লোক কৃষির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে গুরুতর সংকটগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান হলো খাদ্য সংকট। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বিপুল সংখ্যক মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন অপ্রতুল। ফলে প্রতি বছরই প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে অন্যান্য দেশ থেকে খাদ্য ও খাদ্যশস্য আমদানি করতে হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ- দুর্বল হয়ে পড়ছে।
খাদ্য সমস্যার স্বরূপ:
মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে প্রথম ও প্রধান চাহিদা হলো খাদ্য। কিন্তু একটি দেশের নানাবিধ আর্থ-সামাজিক সমস্যার প্রভাবে দেশের সকল মানুষের এই মৌলিক চাহিদাটি যথাযথভাবে পূরণ হয় না। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সব দেশেই জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন কম হওয়ার ফলে খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থাৎ চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ না থাকা এবং এর ফলে সৃষ্ট নানাবিধ সমস্যাকেই এককথায় খাদ্য সংকট বলা হয়। উন্নয়নশীল দেশ হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর কৃষি জমিতে প্রতিবছর সাড়ে ৩ কোটি মেট্রিক টন চাল উৎপাদিত হয় যা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। উৎপাদিত চালের অনুপাতে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে প্রতিবছর চালের ঘাটতি থাকে প্রায় ১ কোটি টন।
বাংলাদেশের অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:
প্রাচীন বাংলায় খাদ্য সংকট ছিল বলে জানা যায় না। মূলত ১৯৪৭ পরবর্তী বিভাগোত্তরকালে আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাবে খাদ্য সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। ১৯৫৩ সালের পর থেকে এ সমস্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। ১৯৭১ এর দুর্ভিক্ষপীড়িত, যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাড়ায় খাদ্য সংকট। যদিও বর্তমানে এ সমস্যা সমাধানে সরকার কর্তৃক নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের কারণ:
বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্য সমস্যার বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান কারণগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-
দারিদ্র্য: বাংলাদেশের কৃষকরা সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে থাকে। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে টাকার অভাবে জমিতে ঠিক মতো সার, সেচ, উন্নতমানের বীজ প্রভৃতি প্রয়োগ করতে পারে না। আর তাই উৎপাদনও কম হয়।
সনাতন কৃষি পদ্ধতি: অতীতে যে সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করা হতো, বর্তমানেও সেই একই পদ্ধতিতে চাষ করা হচ্ছে। এর ফলে বৃহত্তর জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না।
চাষের জমির স্বল্পতা: বাংলাদেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর। কিন্তু জমি ভাগাভাগি করতে গিয়ে জমিতে আইল দেয়া এবং শিল্পায়নের জন্য আবাদী জমি ব্যবহারে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ধীরে ধীরে কমছে। তাই স্বল্প জমিতে ফসল উৎপাদন করে গোটা দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি: দেশে খাদ্য সংকটের প্রধান সমস্যা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধির সাথে সাথে দেশে খাদ্য চাহিদাও বাড়ছে। কিন্তু কৃষিজমির পরিমাণ বাড়ছে না। বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যের যোগান দিতে পারছে না কৃষিজমিগুলো।
কৃষকের অশিক্ষা: এদেশের কৃষকেরা অশিক্ষিত হওয়ায় তারা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদের ব্যাপারেও অজ্ঞ। কীটনাশক, সার, বীজ প্রভৃতি জমিতে প্রয়োগের সঠিক মাত্রা ও সময় তারা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ। ফলে প্রতিবছর খাদ্য ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে।
ভূমিহীন চাষী: আমাদের দেশের বেশীর ভাগ কৃষক অন্যের জমিতে বর্গাচাষ করে। তাদের নিজস্ব কোনো জমি নেই। উৎপাদিত ফসলের সিংহভাগই জমির মালিকের ঘরে উঠবে এই ভেবে কৃষকেরা ফসল উৎপাদনে অধিক মনোযোগ দেয় না। ফলে অনিবার্যভাবেই ফসল উৎপাদন কমে যায়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ; প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ বাংলাদেশে বন্যা, খরা, অনাবৃষ্টি, ভূমি ক্ষয় প্রভৃতি নানা কারণে উৎপাদিত প্রচুর ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দেশে দারুণভাবে খাদ্য ঘাটতি সৃষ্টি হয়।
কৃষি ঋণের জটিলতা: কৃষি মৌসুমে কৃষককে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের কথা থাকলেও এই ঋণ প্রদানের পদ্ধতি বেশ জটিল। ফলে কৃষকেরা আধুনিক যন্ত্রপাতি, সার, বীজ, কীটনাশক প্রভৃতির জন্য পর্যাপ্ত কৃষিঋণ পায় না। আর এরই ফলস্বরূপ ফসল উৎপাদনও আশানুরূপ হয় না।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
খাদ্য সংকট সমাধানের উপায়:
খাদ্য সংকট সমাধান করতে হলে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হবে। আর খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে হলে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক। সনাতন পদ্ধতির কৃষিকাজ পরিহার করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করতে হবে। আমাদের দেশে যেভাবে মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য জমিতে আইল দিয়ে জমি খন্ডে খন্ডে ভাগ করা হয় তাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে চাষ করা বেশ ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে ভূমিসত্ত্ব আইন সংশোধন করে সমবায় পদ্ধতিতে এক খামারে এক আইলে চাষ করলে উৎপাদন বাড়বে। গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে সময়মতো সেচের ব্যবস্থা করা গেলে ফসল উৎপাদন অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে। সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ করে জমির উর্বরতা বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। ফসলের মৌসুমে কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনে চাষ করতে পারে।
কৃষকদের যথাসম্ভব শিক্ষিত করে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে যেন তারা আধুনিক চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সচেতনতা লাভ করতে পারে। শিক্ষিত যুব সমাজের অংশগ্রহণে গরু-ছাগল, মৎস্য, হাস-মুরগী ও কৃষি খামার গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এতে করে মাছ-মাংস প্রভৃতি খাদ্য উৎপাদন বাড়বে এবং জৈব সার উৎপাদনে কৃষকের বাড়তি খরচ প্রশমিত হবে যা কৃষিকাজকে পরিবেশনির্ভর ও দূষণমুক্ত রাখবে। মাটির ধরণ, উর্বরতা ও উৎপাদনশীলতার উপর ভিত্তি করে গোটা দেশের আবাদী জমিকে ভাগ করে নিতে হবে এবং এর মধ্যে কম উৎপাদনশীল জমিগুলোকে চিহ্নিত করে বাড়তি পরিচর্যা ও প্রযুক্তির ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। বছরে একটি জমিতে কেবলমাত্র একটি বা দুটি ফসল নয় বরং সারা বছর মৌসুমভিত্তিক ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর কীটপতঙ্গের প্রাদুর্ভাবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে যায়। জমিতে সঠিক মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে।
এছাড়া উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে প্রতি বছর প্রায় ৭% শস্য নষ্ট হয়ে যায়। পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি এবং গুদামজাতকরণের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করে খাদ্যশস্যকে পচনের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট খাদ্য সংকট এবং খাদ্যদ্রব্য পাচাররোধ করতে সরকারকে উপযুক্ত আইন প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। জনসংখ্যার ঊর্ধ্বগতি রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে উৎপাদিত খাদ্যের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। খাদ্যের বাড়তি চাহিদা পূরণে প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ১০ লাখ মেট্রিক টন পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে।
আরও পড়ুনঃ রচনা
সরকারি উদ্যোগ:
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া দেশের খাদ্য সংকট সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই খাদ্য সংকট সমাধানে বেশ কিছু কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উন্নতমানের বীজ সরবরাহ, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি প্রণয়ন, উন্নত যন্ত্রপাতি, সার, বীজ, কীটনাশক প্রদান, কৃষি ঋণের ব্যবস্থা, বকেয়া কৃষি ঋণ ও খাজনার ক্ষেত্রে ভর্তুকি, ফসল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ, কৃষিভিত্তিক গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা প্রভৃতি কার্যকরী পদক্ষেপগুলো ইতোমধ্যেই সরকারিভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং হচ্ছে। যার ফলে কৃষিতে পূর্বের তুলনায় ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
উপসংহার:
দেশের ক্রমবর্ধমান খাদ্যসংকট দেশের অর্থনীতিতে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তাই যতো দ্রুত সম্ভব খাদ্য সংকট সমাধানের কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু সরকারিভাবেই নয় বরং একই সঙ্গে বেসরকারিভাবেও সহযোগীতা অত্যাবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বাড়ানো গেলেই জাতীয়ভাবে খাদ্যসংকট মোকাবেলা করা এবং দেশের সকল মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।