মানবজীবনে অবকাশ রচনা- সংকেত: ভূমিকা; মানসিক প্রশান্তি লাভে অবকাশ; শারীরিক সুস্থতায় অবকাশ; বিশ্রাম ও কাজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত; অবকাশ যাপনের বিভিন্নতা; অবকাশ যাপন পদ্ধতির ক্রমবিবর্তন; ছাত্র জীবনে অবকাশ; বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অবকাশ যাপন; অবকাশ বনাম অলসতা; উপসংহার।
মানবজীবনে অবকাশ রচনা
ভূমিকা:
পৃথিবী ছুটছে তার আপন গতিতে। এই গতিময় পৃথিবীর সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে মানুষ সর্বদা ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা মানুষকে করে তুলেছে যান্ত্রিক। যান্ত্রিক মানুষ অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে তার প্রয়োজন মেটাতে। কিন্তু শুধুমাত্র কাজই মানুষের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে পারে না। অবিরাম পরিশ্রম করতে করতে মানুষ একসময় হাঁপিয়ে ওঠে। শারীরিকভাবে যেমন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তেমনি মানসিকভাবেও হয়ে পড়ে অবসাদগ্রস্ত। সবকিছু মনে হয় অর্থহীন, জীবনের সব অর্জন মনে হয় তুচ্ছ। তখন মানুষের শ্রান্ত-ক্লান্ত প্রাণ একটু অবকাশের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কর্মময় জীবনকে ছুটি দিয়ে মন খোঁজে একটু নিভৃত শান্তি।
মানসিক প্রশান্তি লাভে অবকাশ:
মানুষের চাহিদার কোনো শেষ নেই। মানুষ তার নানামাত্রিক চাহিদা পূরণে সব সময়ই ব্যস্ত। কর্মব্যস্ততা মানুষের জীবনকে গতিময়তা দান করে। নানা রকমের কাজে ব্যস্ত থাকলে মানুষ আজেবাজে চিন্তা-ভাবনা থেকে মুক্ত থাকতে পারে। কিন্তু এ কর্মব্যস্ততা মাঝে মাঝে অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায়। কর্মময় জীবনের কৃত্রিম জালে আবদ্ধ মানুষ ভাবলেশহীন যন্ত্রে পরিণত হয়। ব্যস্ততার এ জাল ছিড়ে সামান্যতম অবকাশ যাপন করার মতো সময় থাকে না। নিজের ভালো লাগা মন্দ লাগাকে মানুষ বিক্রি করে ফেলে কর্মব্যস্ত জীবনের কাছে। এর প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। অবকাশহীন একঘেয়ে কর্মজীবন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে মানুষকে। এর প্রভাবে নানা রকম জটিল মনোরোগ দেখা দেয়। এতে মানুষের আচরণে অনেক অস্বাভাবিকতা আসতে পারে। অনেক সময় হতাশা ও বিষণ্নতা জীবনে স্থায়ী রূপ লাভ করে। তাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে অবকাশের গুরুত্ব অপরিসীম।
শারীরিক সুস্থতায় অবকাশ:
বিরামহীন কাজ মানুষের নানা শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করে। মানবদেহ অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। প্রতিদিন নানা রকমের পরিশ্রমে কিছু কিছু কোষ মারা যায় বা তাদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কাজ শেষে যখন মানুষ বিশ্রাম নেয় তখন, এ কোষগুলো পুনরায় সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই কাজের ফাঁকে ফাঁকে অবশ্যই বিশ্রাম করা প্রয়োজন। কথায় আছে- ‘সুস্থ দেহ, প্রফুল্ল মন, কর্মব্যস্ত সুখি জীবন।’ দেহ সুস্থ থাকলে সব কাজই আনন্দময় হয়। শারীরিক সুস্থতা সকল সাফল্যের মূল। শরীর সুস্থ না থাকলে তার প্রভাব মনের উপরেও পড়ে। ফলে সার্বিক সুখ-শান্তি নষ্ট হয়। তাই শারীরিক সুস্থতার জন্য অবকাশের গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
বিশ্রাম ও কাজ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত:
প্রত্যেক মানুষই ধন-মান, বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ হতে চায়। সকলের মধ্যমনি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সবাইকে পেছনে ফেলে উঠে যেতে চায় সাফল্যের শীর্ষে। ফলে আমাদের সমাজে সব সময়ই একে অন্যকে পেছনে ফেলার এক রকম প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এ প্রতিযোগিতা মানুষকে পাগল করে তোলে। নিজেকে সামান্যতম অবকাশ কেউ দিতে চায় না। পাছে অন্য কেউ তার চেয়ে অধিক উন্নতি করে ফেলে। অবকাশহীন একটানা পরিশ্রমকেই তারা সাফল্যের একমাত্র পথ মনে করে। অবকাশহীন একটানা পরিশ্রমই সাফল্যের প্রধান উপায় নয়। অবকাশ কাজের উদ্যম বাড়ায়। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে কাজ করলে সে কাজ অনেক বেশি সফল হয়।
অবকাশ যাপনের বিভিন্নতা:
পৃথিবীতে অনেক রকমের মানুষ, অদ্ভূত তাদের স্বভাব। একেক জনের জীবনযাত্রা একেক রকম। তাদের অবকাশ যাপনেও রয়েছে ভিন্নতা। কেউ অবসরে খোঁজে নিস্তব্ধ প্রশান্তি, কেউবা চায় হৈ-হুল্লোড়। কেউ অবসরে চায় আপনজনদের সান্নিধ্য, কেউ বা একলা চলে জীবনকে উপভোগ করতে। অবসরে অনেকে যায় বিশাল পর্বতের উদার সৌন্দর্য দর্শনে, আবার অনেকে যায় গভীর সাগরে জীবনের অর্থ খুঁজতে। কেউবা ভালোবাসে নিবিড় বনের নিশ্চুপ পরিবেশে অবকাশ যাপন করতে। অনেকের কাছে অবসর মানে গান, নাটক সিনেমা দেখা, আবার অনেকের কাছে তাস, দাবা, ফুটবল, ক্রিকেট। বইপ্রেমীরা একটু অবসর পেলেই ডুব দেয় কবিতা, উপন্যাসের কল্পনার জগতে, আর আড্ডাবাজরা জমিয়ে তোলে কথার ফুলঝুড়ি। মাছ শিকার যাদের প্রবল নেশা একটু ফুসরত পেলেই তারা ছিপ নিয়ে ছোটে মাছ ধরতে। ভ্রমণ যাদের নেশা সেসব পর্যটকদের সব সময়ই টানতে থাকে বিশাল এ পৃথিবীর নতুন নতুন দর্শনীয় স্থান। একটু অবসর পেলেই তারা চষে বেড়ান পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত। এমনি আরও নানাভাবে মানুষ অবকাশযাপন করে। একঘেয়ে আটপৌরে জীবন থেকে সাময়িক ছুটি নিয়ে উপভোগ করে জীবনের নানামাত্রিক সুখ।
অবকাশ যাপনের ক্রমবিবর্তন:
প্রাচীনকালের অবসর বিনোদনের সাথে বর্তমানের অবসর বিনোদনের অনেক পার্থক্য রয়েছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের অবসর যাপনের পদ্ধতির ক্রমবিবর্তন ঘটেছে। প্রাচীনকালে রাজা-বাদশারা তাদের অবসর বিনোদনের জন্য বিশাল প্রমোদ কানন তৈরি করত। সবরকম বিলাসীতার ব্যবস্থা থাকত সেখানে। তাছাড়াও থাকত নানা রকম শক্তি লড়াই প্রদর্শনী। মানুষের সাথে মানুষের বা পশুর সাথে মানুষের শক্তির লড়াই-এর ব্যবস্থা করা হতো রাজা-বাদশাদের মনোরঞ্জনের জন্য। কিন্তু কালক্রমে এসব নিষ্ঠুর অবসর বিনোদন লোপ পেয়েছে, মানুষ এখন অনেক সভ্য। নিষ্ঠুরতা নয় বরং সৃষ্টিশীল ও আনন্দময় কাজের মাধ্যমেই মানুষ এখন তার অবকাশ যাপন করে। বিশাল কর্মব্যস্ত জীবনে সামান্য ফাঁক পেলেই নিজেকে নিয়োজিত করে মানবতার সেবায়।
আরও পড়ুনঃ রচনা
ছাত্রজীবনে অবকাশ:
ছাত্রদের প্রধান উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা। কিন্তু সারাক্ষণ পড়া, ক্লাস, পরীক্ষায় মন অতিষ্ঠ হয়ে যায়। ছুটির ঘণ্টার জন্য আকুল হয়ে উঠে প্রাণ। মন প্রফুল্ল না থাকলে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। তাই ছাত্রজীবনে অবকাশ যাপনের গুরুত্ব অপরিসীম কিন্তু সেই অবকাশ যাপনের পদ্ধতি যদি শিক্ষামূলক হয় তবে সবচেয়ে ভালো হয়। কারণ বর্তমান কলুষিত সমাজে পদে পদে নানা বিপদ জাল বিস্তার করে আছে। অবকাশ যাপনের নামে ছেলেমেয়েদের নানা অন্যায় কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। এ সময়ে তারা পৃথিবীকে রঙ্গীন চোখে দেখে। নিজেদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে পা বাড়ায় অন্ধকার জগতে। খারাপ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে জড়িয়ে পড়ে নানা রকমের নেশায়, হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত। আবার অনেকে অবসরযাপনের নামে সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করে। ফলে তারা শিক্ষাজীবনে সাফল্য লাভ করতে পারে না। তাই ছাত্রজীবনের অবকাশ যাপন পদ্ধতি হওয়া উচিত শিক্ষা সম্পর্কিত ও পরিমিত। আজকের ছাত্ররাই আগামীতে জাতির কর্ণধার। তারা যদি নেতৃত্বদানে যোগ্য হতে না পারে তবে জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। তাদের পড়াশুনার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রমেও পারদর্শি হওয়া দরকার। তাই ছাত্ররা নানা রকম শিক্ষাসফর, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা, চিত্রাঙ্কন ও সমাজ সেবামূলক কাজের মাধ্যমে তাদের অবসর যাপন করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অবসরযাপন:
বাংলাদেশ নিন্ম আয়ের দেশ। এখানে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্ত মানুষের সংখ্যাই বেশি। এসব মানুষ তাদের জীবিকার প্রয়োজনে অন্যের ক্ষেত-খামার বা কলকারখানায় কাজ করে। আমাদের পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের দৃষ্টি ভালো নয়। তারা তাদের অধীনস্ত দরিদ্র শ্রমিকদের দিয়ে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করিয়ে নেয়। শ্রমিকদের অবকাশ যাপনের কোনো সুযোগই তারা দেয় না। এতে শ্রমিকরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কাজে ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারে না। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। অথচ মালিকরা এ বিষয়ে দৃষ্টি দেয় না। তাদের ধারণা শ্রমিকদের দিয়ে বেশি কাজ করালেই নিজেদের লাভ বেশি হবে। উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিকদের অবকাশযাপনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা জন্য তারা কাজের ফাঁকে পর্যাপ্ত সময় পায়। ফলে তারা যেমন শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকে তেমনি তাদের কাজের মানও উন্নত হয়। এতে মালিকরাও বেশি মুনাফা অর্জন করতে পারে। আমাদের দেশেও এই ব্যবস্থার প্রচলন ঘটানো যেতে পারে।
অবকাশ বনাম অলসতা:
অবকাশ ও অলসতা এক বিষয় নয়। কর্মব্যস্ত জীবনে সামান্য অবকাশ প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দেয়। অবকাশ যাপনের মধ্য দিয়ে জটিলতা ভুলে মানুষ জীবনকে উপভোগ করে নানাভাবে, যা তার শরীর সুস্থ করে ও মন প্রফুল্ল করে। ফলে সে অবকাশ যাপন শেষে নতুন উদ্যমে আবার তার কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু অবকাশযাপন পরিমিত হওয়া উচিত। অবকাশ যাপনের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলে অলসতায় পরিণত হয়। এটা মোটেই কাম্য নয়। অলসতা মানুষের সাফল্যের পথে প্রধান অন্তরায়। অলসতা মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু করে দেয়। অলস মানুষ কোনো কাজেই উদ্যম পায় না। ফলে তার জীবনে কোনো উন্নতিই সম্ভব হয় না। তাই আমাদের খেয়াল রাখতে হবে অবকাশ যাপনের নামে আমরা যেন অলসতা না করি।
উপসংহার:
নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততায় চাপা পড়া মন মাঝে মধ্যেই হারিয়ে যেতে চায় কল্পনার জগতে, পেতে চায় প্রজাপতির মতো অবাধ স্বাধীনতা। ইচ্ছা হয় জীবনের রঙ্গীন স্বপ্নগুলো ছুঁয়ে দেখার। হাজারো চিন্তায় জর্জরিত মন আর্তনাদ করে উঠে সামান্য একটু স্নিগ্ধ অবকাশের আশায়। অবকাশ মানুষের জীবনকে প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর করে তোলে। অবকাশ যাপন যেন নতুন করে জীবন শুরু করার এক প্রস্তুতি পর্ব।