মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) রচনা সংকেত: ভূমিকা; তৎকালীন বিশ্ব ও মুহাম্মদ (স.) এর আবির্ভাবের আবশ্যকতা; বিশ্বনবী (স.) এর আবির্ভাব; প্রাথমিক জীবন; বিবাহ; নবুয়্যত লাভ; ইসলাম প্রচার; হিজরত; ইসলামী রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠা; সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রচার ও কয়েকটি যুদ্ধ; ওফাত; বিশ্বনবী (স.) এর জীবনাদর্শ; বর্তমান ও বিশ্বনবী (স.); উপসংহার।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) রচনা
ভূমিকাঃ
মানুষ ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ বা মহান আল্লাহর সেরা সৃষ্টি। সত্য ও সুন্দরের শিক্ষা দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু যুগে যুগে মানুষ অসত্য, অজ্ঞতা, ভ্রষ্টতা ও কুসংস্কারের গভীর তমসায় আচ্ছন্ন হয়ে ভুলে গেছে আপন পরিচয়, আপন স্রষ্টা আর সত্য-সুন্দরের পবিত্র শিক্ষা। এমন ঘনঘোর অমানিশায় দিশেহারা, পথভ্রষ্ট মানবজাতিকে মুক্ত করতে ধরাধামে আর্বিভূত হন মহাপুরুষরা। তাঁরা আপন আলোয় উদ্ভাসিত করেন অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবী, মানুষকে বলে দেন মুক্তির দিশা। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) এমনই একজন মানুষ যিনি মানবতার মুক্তির দিশারি, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ।
তৎকালীন বিশ্ব ও মুহাম্মদ (স.) এর আবির্ভাবের আবশ্যকতাঃ
বিশ্বনবী (স.) আর্বিভাবের পূর্বে সমগ্র পৃথিবী ছিল অন্ধকারে আচ্ছন্ন। অনাচার, অবিচার আর ব্যভিচারে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল গোটা জগত। আরব, পারস্য, ভারতবর্ষ তৎকালীন সভ্য জগতের সবখানেই নিভে গিয়েছিল সত্যের আলো। সে সময় আরবের অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। আইয়ামে জাহিলিয়ার সেই বীভৎস যুগে মানুষ ছিল শান্তিহারা, অধিকারহারা, নির্মম ভাবে অত্যাচারিত ও নিপীড়িত। মদ্যপান, জুয়া, নারীসম্ভোগ, গোত্রীয় দ্বন্দ্ব, দস্যুবৃত্তি, নরহত্যা প্রভৃতি ছিল সে সময়ের আবর সমাজের সাধারণ চিত্র। নারী জাতির অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। গৃহপালিত পশুর মতো আচরণ করা হত নারীর সাথে। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে জীবন্ত কবর দেয়া হত। এহেন অবস্থা একজন ত্রানকর্তার আর্বিভাব যেন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। যিনি অমানিশার আধাঁর বিদীর্ণ করে জ্বালবেন মুক্তির আলো।
বিশ্বনবী (স.)-এর আর্বিভাবঃ “জগৎ জুড়িয়া জ্বলছিল যবে হাবিয়া জাহান্নাম
স্বর্গ হইতে আসিলেন নবী, লয়ে শান্তি পয়গাম”
মুক্তির আলোকবার্তা নিয়ে পৃথিবীতে এলেন নিখিলের চিরসুন্দর সৃষ্টি মুহাম্মদ (স.)। সমগ্র সৃষ্টি জগতে যেন বয়ে গেল আনন্দের ফল্গুধারা। হযরত মুহাম্মদ (স.) আরবের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমেনা।
আরও পড়ুনঃ রচনা
প্রাথমিক জীবনঃ
মহানবী (স.)-এর জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ ইন্তেকাল করেন। ছয় বছর বয়েসে মমতাময়ী মা পরলোকগমন করলে শিশুনবী পিতৃ-মাতৃহীন হয়ে পড়েন। কিছু দিন বৃদ্ধ পিতামহ আব্দুল মুত্তালিবের স্নেহ ছায়ায় লালিত-পালিত হন। ৮ বছর বয়সে দাদার ইন্তেকালের পর পিতৃব্য আবু তালিবের সংসারে বড় হতে থাকেন। বাল্যকালে তাঁর চারিত্রিক মাধুর্য, সততা, সরলতা, আমানতদারী বিশ্বস্ততা, কর্তব্যনিষ্ঠা প্রভৃতি গুণাবলিতে মুগ্ধ হয়ে মক্কাবাসীরা তাঁকে ‘আল-আমিন’ তথা ‘বিশ্বাসী’ উপাধিতে ভূষিত করে।
বিবাহঃ
যুবক মুহাম্মদ (স.) এর অসাধারণ বিশ্বস্ততা ও দায়িত্বশীলতায় মুগ্ধ হয়ে মক্কার ধনবতী বিধবা মহিলা খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা.) স্বীয় ব্যবসার দায়িত্বভার প্রদান করেন। ক্রমেই বিবি খাদিজা মহানবী (স.) এর অসামান্য চারিত্রিক গুণাবলীর প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। অতঃপর খাদিজার প্রস্তাবের ভিত্তিতে উভয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সে সময়ে মুহাম্মদের (স.) এর বয়স ছিল ২৫ বছর ও খাদিজা (রা.) এর বয়স ছিল ৪০ বছর।
নবুয়্যত লাভঃ
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি নবুয়্যত প্রাপ্ত হন। আল্লাহর নির্দেশে ফেরেশতা জিবরাঈল তাঁর নিকট ওহী নিয়ে আসেন ‘পড়, তোমার প্রভুর নামে; যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’। (আল-আলাক-০১)
ইসলাম প্রচারঃ
নবুয়ত প্রাপ্তির পর স্বীয় দায়িত্ব পালনে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আল্লাহর একত্ববাদ, ইসলামের সওদা তথা মুক্তির পয়গামে তিনি হাজির হন পথ ভোলা মানুষের কাছে। বিবি খাদিজা (রা.) প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর আবু বকর (রা.) সহ একে একে অন্যান্যরা কালিমার দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলে কায়েমী স্বার্থবাদী সমাজপতিরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। তারা মুহাম্মদের (স.) প্রচার কাজকে স্তব্ধ করে দিতে নানা অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। কিন্তু এতে তিনি একটুও বিচলিত হননি।
হিজরতঃ
হাজারো নির্যাতন কিংবা প্রলোভনেও মুহাম্মদ (স.) স্বীয় দায়িত্ব থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত না হওয়ায় কুরাইশ সমাজপতিরা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। আপন মানুষদের এই মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর আদেশে তিনি ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদীনায় হিজরত করেন।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাঃ
মুহাম্মদ (স.) এর অমায়িক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও অসাধারণ নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ হয়ে মদিনাবাসী আনন্দচিত্তে তাঁর আনুগত্য মেনে নেয়। তিনি মদিনাকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্র পরিচালনা ও সকল গোত্রের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি ‘মদীনা সনদ’ প্রণয়ন করেন।
সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রচার ও কয়েকটি যুদ্ধঃ
সমগ্র বিশ্বে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য শান্তির নবীকেও যুদ্ধ করতে হয়েছে। আল্লাহর র্নিদেশে নিজেকে রক্ষার্থে পরিচালিত এসব যুদ্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-বদর, উহুদ, খাইবার, তায়িফ, হুনাইন, আহযাব প্রভৃতি। ৬৩০ খিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বিনা রক্তপাতে মুহাম্মদ (স.) মক্কা জয় করেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন রক্তপাতহীন নিরঙ্কুশ বিজয় আর দ্বিতীয়টি নেই।
ওফাতঃ
রাসূল (স.) ৬৩ বছর বয়সে ১১ হিজরীর ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে ইহধাম ত্যাগ করে পরলোকে গমন করেন।
বিশ্বনবী (স.) এর জীবনাদর্শঃ
মহান আল্লাহ বলেন- “নিশ্চয়ই আপনি সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী” (সূরা কালাম-৪)। মুহাম্মদ (স.) এর চারিত্রিক মহিমায় মৃুগ্ধ ইউরোপের বিশ্ব বিখ্যাত মহাবীর নেপোলিয়ান বোনাপার্ট তার “অটোবায়োগ্রাফী” তে বলেছেন- “আমি আল্লাহর মহিমা কীর্তন করি, এবং পূত চরিত্র ও দিব্য প্রেরণা দীপ্ত মোহাম্মদকে আর পবিত্র কোরাআনকে শ্রদ্ধা নিবেদন করি।”
অনাড়ম্বর মুহাম্মদ (স.): এক্ষেত্রে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য- “তিনি ছিলেন কথাবার্তায় সব চেয়ে মিষ্টি ভাষি, সবচেয়ে মনোজ্ঞ। তাকে যারা দেখেছেন তারা আবেগাপ্লুত হয়েছেন- অপ্রত্যাশিতভাবে। যারা কাছে এসেছেন তারা তাঁকে ভালোবেসেছেন। পরে তারা বিবরণ দিয়েছেন তাঁর মতো মহামানব আগে কখনো দেখিনি পরেও না। মোহাম্মদ (স.) এর স্মৃতিশক্তি ছিল গভীর, তাঁর রসিকতা ছিল শালীন। তাঁর কল্পনা ছিল উন্নত ও মহৎ। তাঁর বিচার বুদ্ধি ছিল তীক্ষ্ণ। জাগতিক শক্তির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছেও মুহাম্মদ (স.) নিজ গৃহের কাজগুলো করতেন। তিনি আগুন জ্বালাতেন, ঘর ঝাড় দিতেন, দুগ্ধ দোহন করতেন এবং নিজ হাতে কাপড় সেলাই করতেন।”
বিশ্বস্ততাঃ
অসামান্য বিশ্বস্ততার দরুন বাল্যকালেই তিনি আল-আমিন উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি বিশ্বস্ততার চির মূর্তপ্রতীক। লেবাননের হিট্টি বংশীয় প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ফিলিপ হিট্টি বলেন- “তিনি কখনও ওয়াদা খেলাফ করেননি বা কাউকে প্রতারিত করেননি।”
ক্ষমাঃ
ত্রিভুবনের রহমতস্বরূপ প্রেরিত হন তিনি। প্রতিশোধ নয়, ক্ষমাশীলতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের মধ্য দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেন। চূড়ান্ত মক্কা বিজয়ে তিনি তাঁর হত্যার পরিকল্পনাকারীদেরও অপূর্ব ক্ষমায় মুক্ত করে দেন।
কর্মী মুহাম্মদ (স.)ঃ
শুধু বাগ্মিতাই নয়, স্বীয় আর্দশ বাস্তবায়নে বিরামহীন প্রচেষ্টা তাঁর জীবনকে করে তুলেছে বিপুল কর্মময়। প্রফেসর লামাটিন তাঁর ‘তুরস্কের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “দার্শনিক, বাগ্মী, ধর্ম প্রচারক, আইন প্রণেতা, যোদ্ধা, আদর্শ বিজেতা, মানবিক রীতি-নীতির প্রবর্তনকারী এবং একটি ধর্মীয় সাম্রাজ্য ও বিশটি জাগতিক সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা যিনি তিনি মোহাম্মদ।”
বর্তমান বিশ্ব ও বিশ্বনবী (স.)ঃ
সমস্যাসঙ্কুল অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানব জাতির সর্বাত্নক মুক্তির একমাত্র পথ বিশ্বনবীর (স.) জীবনাদর্শ বাস্তবায়ন। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক প্রভৃতি সার্বিক মুক্তির অপূর্ব পথ তিনি বাতলে দিয়েছেন। এ সত্য আজ প্রতিষ্ঠিত যে, তাঁর প্রবর্তিত অর্থনৈতিক নীতিমালা অনুস্মরণে আজও মানবজাতিকে রাষ্ট্রের দাসত্ব ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে প্রকৃত সুখী করা সম্ভব। রাজনৈতিক মুক্তির দিকনির্দেশনা উল্লেখ করে পাশ্চাত্যের খ্যাতিমান মনীষী র্জজ বার্নার্ড শ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, I belive if man like Mahammad (sm) were to assume the dictatorship of modern world, he would succeed in solving the problems in way that would bring much needed peace and happiness.
বর্তমান নারীরা নির্যাতিত, নিগৃহীত সর্বত্র। এমতবস্থায় বিশ্বনবীর (স.) দিকনির্দেশনাই নারীকে দিতে পারে মুক্তি। প্রাচ্য পন্ডিত গিব তাঁর “মোহাম্মডেনিজম” গ্রন্থে বলেছেন- “আজ এটা এক বিশ্বজনীন সত্য যে, মোহাম্মদ নারীদেরকে উচ্চতর মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন।”
উপসংহারঃ
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বিশ্বনবী (স.)। তাঁর আগমনে সুন্দর পেয়েছে পূর্ণরূপ, পৃথিবী খুঁজে পেয়েছে সার্থকতা। রাঙ্গা রবির মতো তিনি এসেছিলেন অন্ধকার দূরীভূত করতে। কবি নজরুলের ভাষায়-
যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে
তোরা দেখে যা আমেনা মায়ের কোলে।