ক্রিকেট খেলা ও বাংলাদেশ রচনা- সংকেত: ভূমিকা; ক্রিকেটের ইতিহাস; খেলার নিয়ম; বাংলাদেশ ও ক্রিকেট; আইসিসিতে বাংলাদেশ; টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশ; একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ; বিশ্বকাপে বাংলাদেশ; T-২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশ; আইসিসির শীর্ষ পদে বাংলাদেশি; উপসংহার।
ক্রিকেট খেলা ও বাংলাদেশ রচনা
ভূমিকাঃ
বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা হিসেবে ক্রিকেট তার স্থান দখল করে নিয়েছে বিশ্ব অঙ্গনে। শক্তি, সৌন্দর্য ও বিচক্ষণতা খেলাটিকে রাজকীয় মর্যাদা দান করেছে। আর অনিশ্চয়তা এই খেলাটি দিয়েছে উত্তেজনা, উদ্দীপনা ও জনপ্রিয়তা। ক্রিকেটে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা লাভ আমাদের গৌরবকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশ্বে বহু দেশ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেটে আজ ‘টপটেন’ এ অবস্থান করছে।
ক্রিকেটের ইতিহাসঃ
ক্রিকেট খেলার উৎপত্তি হয় ইংল্যান্ডে। ১৩ শতকে রাজা প্রথম এডওয়ার্ডের সময় ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে লেখা একটি বইতে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। সে সময় ইংল্যান্ডে ‘স্টু’ বল নামে এক রকম খেলার প্রচলন ছিল। সেখান থেকে পরবর্তীতে আঠার শতকে ক্রিকেট খেলা ইংল্যান্ডে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপর ১৮৭৭ সালে ১৫-১৭ মার্চ ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে প্রথম টেস্ট খেলার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটে। বর্তমানে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশসহ ১০টি দেশ ক্রিকেটের অভিজাত টেস্ট খেলুড়ে দেশ। প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলা শুরু হয় ১৯৭৫ সালে। একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা হয় ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি। আর ক্রিকেটের সর্বশেষ সংস্করণ টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সাল থেকে।
খেলার নিয়মঃ
ক্রিকেট খেলায় একটি বড় মাঠ দরকার হয়। মাঠের মাঝখানে ২২ গজ দৈর্ঘ্যরে একটি পিচ থাকে। পিচের দুই প্রান্তে তিনটি করে স্টাম্প থাকে। মাটি থেকে যার উচ্চতা ২৭/২৮ ইঞ্চি। স্টাম্পের উপরে ৪ ইঞ্চি লম্বা দুই টুকরা শক্ত কাঠ আলগা করে চাপানো থাকে, যাকে আমরা বেল বলি। দুই দিকের উইকেটের দুই পাশে এক লাইনে ৪ ফুট করে একটি সোজা দাগ কাটা থাকে যাকে বলে ‘বোলিং ক্রিজ।’ আবার উইকেট থেকে ৪ ফুট এগিয়ে আরেকটি সমান্তরাল দাগ কাটা থাকে যাকে বলে ‘পপিং ক্রিজ’। এই খেলায় প্রতি দলে ১১ জন করে খেলোয়াড় থাকে। দুটি দলের মধ্যে ব্যাট ও বলের খেলা ডিম্বাকৃতি মাঠ বা গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত হয়। খেলা পরিচালনার জন্য আম্পায়ার নিযুক্ত থাকে। মাঠে দুজন আম্পায়ার ও মাঠের বাইরে একজন টিভি আম্পায়ার থাকেন। এই খেলায় ব্যাটিং পক্ষের উদ্দেশ্য থাকে প্রতিপক্ষের ফিল্ডিং বেষ্টনীকে ফাঁকি দিয়ে বল মেরে রান সংগ্রহ করা। আর বোলিং পক্ষের লক্ষ্য হলো প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে আউট করা।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
ক্রিকেটে ব্যাটের প্রস্থ সর্বাধিক ৪.৫ ইঞ্চি এবং ব্যাটের দৈর্ঘ্য সর্বাধিক ৩৮ ইঞ্চি। ক্রিকেটে যে বল ব্যবহার করা হয় তার পরিধি ২৫০ সেন্টিমিটার এবং এর ওজন প্রায় ১৬০ গ্রাম। একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে ৫০ ওভারের দুই ইনিংস খেলা নির্ধারণ করা হয়। অপরদিকে টেস্ট খেলার জন্য ৫ দিন বা চার ইনিংস কমপক্ষে ৩০ ঘণ্টার খেলা নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বল্প সময়ের খেলা টি-টুয়েন্টির জন্য ২০ ওভার নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রতি ওভারে ছয়-বার করে বল করতে হয়। ক্রিকেট দশ উইকেটের খেলা। একজন ব্যাটসম্যান দশটি উপায়ে আউট হতে পারেন। যার মধ্যে পাঁচ রকমের আউট সচরাচর দেখা যায়-বোল্ড, কট, এলবিডব্লিউ, স্ট্যাম্প, রান আউট, আর বাকি পাঁচটি হচ্ছে হিট উইকেট, টাইমড আউট, হিট দ্যা বল টোয়াইস, অবস্ট্রাকটিং দ্যা ফিল্ড ও হ্যান্ডেল্ড দ্য বল। খেলা চলাকালীন সময়ে বোলিং পক্ষের ফিল্ডিং এর অবস্থান হলো বোলার, উইকেট কিপার, স্লিপ, গালি, থার্ডম্যান, কাভার, সিলি মিড অফ, সিলি মিড অন, স্কয়ার ল্যাগ ও লংলেগ। এভাবে ক্রিকেট খেলা হয়, আর যে দল যতো বেশি রান নিতে পারে সে দলই জয়ী হয়।
বাংলাদেশ ও ক্রিকেটঃ
বাংলাদেশে ক্রিকেটের যে শিকড় তা অনেক গভীরে বিদ্যমান। বাংলাদেশ ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে স্বাধীনতার পর পরই। তাই স্বাধীনতা লাভের অল্প দিনের মধ্যেই ১৯৭৩ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি)। যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। তারপর আইসিসি’র (International Cricket Council) সহযোগী সদস্য দেশ হিসেবে নির্বাচিত হয় ১৯৭৭ সালের ২৬ জুলাই। বাংলাদেশ একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্ট্যাটাস লাভ করে ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন। আইসিসির পূর্ণাঙ্গ সদস্য বা টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে ২৬ জুন, ২০০০ সালে। প্রথম বিশ্বকাপ খেলে ১৯৯৯ সালে আর টি-টুয়েন্টি ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে।
এক নজরে ক্রিকেট বাংলাদেশের অগ্রগতি-
১৯৭৩ সালঃ বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড গঠন।
১৯৭৫ সালঃ পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট বোর্ড গঠিত।
১৯৭৬ সালঃ MCC ক্লাব বাংলাদেশে সফর করার মধ্য দিয়ে প্রথম বিদেশি দলের সাথে খেলা।
১৯৭৭ সালঃ ICC-সহযোগী সদস্য পদ লাভ।
১৯৭৯ সালঃ প্রথম ICC-কাপে অংশগ্রহণ।
১৯৮৬ সালঃ এশিয়া ট্রফিতে প্রথম বারের মতো অংশগ্রহণ।
১৯৮৮ সালঃ তৃতীয় এশিয়া কাপের আয়োজন এবং প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের আয়োজক বাংলাদেশ।
১৯৯৬ সালঃ বিসিসিবি নাম পরিবর্তন করে বিসিবি নামকরণ করা হয়।
১৯৯৭ সালঃ বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা অর্জন করে।
১৯৯৮ সালঃ প্রথমবারের মতো আইসিসি মিনি বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের আয়োজক।
১৯৯৯ সালঃ প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ।
২০০০ সালঃ স্বপ্নের টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করে।
২০০১ সালঃ দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজে অংশগ্রহণ।
২০০৫ সালঃ জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজ জয়।
২০১১ সালঃ যৌথভাবে এবং প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আয়োজন (১০ম বিশ্বকাপ)। প্রথম বারের মতো এশিয়া কপে ফাইনালে ওঠে এবং রানার আপ হয়।
২০১৪ সালঃ ৫ম টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপের একক আয়োজক হয় বাংলাদেশ।
আরও পড়ুনঃ রচনা
আইসিসিতে বাংলাদেশঃ
বাংলাদেশ ১৯৭৯ সালে প্রথম আইসিসি টুর্নামেন্ট খেলে। প্রথম টুর্নামেন্ট থেকে ষষ্ঠ আইসিসি টুর্নামেন্ট ’৯৭ পর্যন্ত বাংলাদেশ সবকটি খেলায় গৌরবের সাথে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৯-এর প্রথম টুর্নামেন্টের ৪টি খেলার মধ্যে ২টি জয়লাভ করে। ১৯৮২ সালের দ্বিতীয় টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটের নজর কাড়তে সমর্থ হয়। ৯টি ম্যাচের মধ্যে ২টি খেলা পরিত্যক্ত হয় আর ৪টি খেলা জয় লাভ করে সেফিফাইনাল পর্যন্ত উঠে। আর এভাবে ধারাবাহিক খেলার মধ্য দিয়ে ষষ্ঠ আইসিসিতে ৫ম বিশ্বকাপের তিন দল আরব আমিরাত, কেনিয়া, হল্যান্ডকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে খেলার স্বপ্ন পূরণ করে।
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশঃ
বাংলাদেশ ২০০০ সালের ২৬ জুন বহুকাক্সিক্ষত টেস্ট খেলার গৌরব অর্জন করে। বর্তমানে টেস্ট খেলুড়ে দেশের সংখ্যা ১০টি। সেসময় আইসিসি’র ২৬টি সহযোগী দেশ এবং টেস্ট খেলুড়ে ৯টি দেশের ২৬+৯=৩৫টি ভোট পেয়ে বাংলাদেশ ১০ম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসাবে বিশ্বক্রিকেটে প্রবেশ করে। বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলে ভারতের বিপক্ষে, ২০০০ সালের ১০-১৪ নভেম্বর। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ৮৩টি টেস্ট খেলেছে। এর মধ্যে জয় পেয়েছে ৪টিতে। পরাজিত হয়েছে ৬৮টি ম্যাচ আর ড্র করেছে ১১টি ম্যাচ।
পরিসংখ্যানে বাংলাদেশে টেস্ট ক্রিকেটঃ
প্রতিপক্ষ ম্যাচ জয় পরাজয় ড্র
অস্ট্রেলিয়া ৪ ০ ৪ ০
ভারত ৭ ০ ৬ ১
ইংল্যান্ড ৮ ০ ৮ ০
নিউজিল্যান্ড ১১ ০ ৮ ৩
পাকিস্তান ৮ ০ ৮ ০
দ. আফ্রিকা ৮ ০ ৮ ০
শ্রীলংকা ১৬ ০ ১৪ ২
ওয়েস্টইন্ডিজ ১০ ২ ৬ ২
জিম্বাবুয়ে ১১ ২ ৬ ৩
মোট ৮৩ ৪ ৬৮ ১১
সূত্র: আইসিসি/বিসিবি
একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশঃ
একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেক ঘটে ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ, শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়া কাপ ক্রিকেটে। ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম প্রতিপক্ষ পাকিস্তান, আর প্রথম ওয়ানডে অধিনায়ক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। বাংলাদেশ ওয়ানডে ক্রিকেট খেলার মর্যাদা লাভ করে ১৯৯৭ সালের ১৫ জুন। একদিনের ক্রিকেটে বাংলাদেশ টপ টেনের সব দেশকেই পরাজিত করার গৌরব অর্জন করেছে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ২৮৬ টি ওয়ানডে খেলেছে, এর মধ্যে ৮০টি জয়, ২০২টি পরাজয় এবং ৪টি খেলা অমিমাংসিত হয়েছে।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশঃ
ক্রিকেটে বাংলাদেশের অভিষেক ঘটে ১৯৯৯ সালের ৭ম বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ প্রথম খেলে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালের ১৭ মে। এই বিশ্বকাপের তৃতীয় ম্যাচেই বাংলাদেশ প্রথম জয় পায় স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে ২৬টি ম্যাচে অংশগ্রহণ করে যার মধ্যে ৮টিতে জয়লাভ করে।
T-20 ক্রিকেটে বাংলাদেশঃ
T-20 ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালে। ঞ-২০ প্রথম বিশ্বকাপ শুরু হয় ২০০৭ সালে। প্রথম T-20 বিশ্বকাপে বাংলাদেশ জয়লাভ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত ৪০টি T-20 ম্যাচে অংশ নিয়েছে যার মধ্যে ১১টি জয় এবং ২৯টি পরাজয়।
আইসিসির শীর্ষ পদে বাংলাদেশিঃ
২০১২-১৪ এ দুই বছরের জন্য ক্রিকেটের বড় সংস্থা আইসিসির সহ সভাপতি নির্বাচিত হন বাংলাদেশের আ. হ. ম. মুস্তাফা কামাল। বর্তমানে তিনি এই সংস্থার সভাপতি। তিনি আইসিসির শীর্ষ পদে প্রথম বাংলাদেশি। আর এভাবেই বাংলাদেশ বিশ্ব ক্রিকেটে কাজ করে চলেছে।
উপসংহারঃ
বাংলাদেশের খেলাধুলার মধ্যে ক্রিকেটের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এদেশের মানুষ জয়ে-পরাজয়ে, সাফল্যে ব্যর্থতায় সব সময় ক্রিকেট দলকে পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে আসছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করছে। সাম্প্রতিককালের বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্য ঈর্ষনীয়। নবজাগ্রত এক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিনিয়ে আনবে বিজয় মাল্য। সে দিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন বাংলাদেশ আইসিসির ট্রফির মতো বিশ্বকাপ ট্রফিও জয় করবে।