মানবাধিকার রচনা সংকেত: ভূমিকা; মানবাধিকারের ধারণা; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস; মানবাধিকার এবং বর্তমান বিশ্ব; মানবাধিকার ও উন্নয়ন; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সুফল; প্রতিবন্ধকতা; মানবাধিকার ও বাংলাদেশ; মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও সংস্থাসমূহের ভূমিকা; বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম; উপসংহার।
মানবাধিকার রচনা
বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার ধারণাটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে, তবে এই ধারণাটি সাম্প্রতিক বা নতুন নয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লালিত বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মধ্যে মানবাধিকারের বিষয়টি খুঁজে পাওয়া যায়। হযরত মুহম্মদ (স.), যিশু খ্রীস্ট, গৌতম বুদ্ধ প্রমুখ মহামানবগণ ছিলেন মানবাধিকার ধারণার প্রবক্তা। বর্তমানকালেও মার্টিন লুথার কিং, মহাত্ম গান্ধী, মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা প্রমুখ ব্যক্তিগণের মধ্যে মানবাধিকারের বিষয়টি স্বরূপে ভাস্বর।
মানবাধিকারের ধারণাঃ
১৯১৪ সালের ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর মানবাধিকারের বিষয়টি মানুষকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তোলে। যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট নানা নৈরাজ্য, দুর্ভিক্ষ, হতাশা, অনাহার, নৈতিকতার অবক্ষয় প্রভৃতি অবস্থা উত্তরণের জন্য সমগ্র বিশ্বে একটি নীতির প্রয়োজন দেখা দেয়, যে নীতি দ্বারা বিশ্বের মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র্যের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে। এছাড়া পরবর্তীতে হিটলারের গঠিত ন্যাৎসী বাহিনীর অমানবিক অত্যাচার ও অনাচার থেকে মানুষকে রক্ষা করার কথা ভেবেছিলেন তৎকালীন বিশ্বের কিছু মানুষ। এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকার। মূলত মানবাধিকার মানে বোঝায়- ক্ষুধা থেকে মুক্তি, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষার সুযোগ লাভ, ব্যক্তিচিন্তার স্বাধীনতা, চিকিৎসার নিশ্চয়তা, সকল অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা, সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমান উন্নতির নিশ্চয়তা প্রভৃতি।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসঃ
মানবাধিকারের সার্বজনীন রূপটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১৪ সালের ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘League of nations’. এটির উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন স্বায়ত্ত্বশাসিত কিংবা Trust Territory গুলোর মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ সাধন করা। ‘League of nations’-এর অঙ্গ সংগঠন ILO এর শ্রমিকের কর্মসময় ও পারিশ্রমিক নির্ধারণ করার মাধ্যমে মানবাধিকারের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। এরপর ১৯৪৪ সালে ওয়াশিংটনের Dumberton Oaks ভবনে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনায় Human Rights প্রসঙ্গটি স্থান পায়। ২৬ জুন, ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। সনদ অনুযায়ী মানুষের মৌলিক অধিকারসমূহ বা Fundamental human Rights হলো Dignity and worth of human Beings বা মানুষের মর্যাদা ও মূল্য, সমঅধিকার, ন্যায়বিচার, সামাজিক অগ্রগতি, মৌলিক স্বাধীনতা, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। পরবর্তীতে ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র বা Universal Declaration of Human Rights গৃহীত হয়। এইদিন ফ্রান্সে UDHR (Universal Declaration of Human Rights) ঘোষণা করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের পত্নী মিসেস ইলিনর রুজভেল্ট। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় মানবাধিকার।
মানবাধিকার এবং বর্তমান বিশ্বঃ
Universal Declaration of Human Rights যখন গৃহীত হয় তখন UNO’র সদস্য ছিল ৫৮। বর্তমানে ১৯৩টি দেশ UNOÕi সদস্য হয়েছে। আর এই সকল দেশই UNOÕi নীতিমালা মেনে চলার জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। মানবাধিকার ঘোষণায় সকল ধর্ম বর্ণের এবং সকল জাতির সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে মানুষের মৌলিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করারও অঙ্গীকার করা হয়।
UDHRÑ এর পথ ধরেই গৃহীত হয়েছে-
i) International convention on Civil and Political Rights.
ii) International convention of Economic, Social and Cultural Rights.
iii) Convention on the Rights of the Child.
iv) International convention on the Elimination of All Forms of Discrimination Against Women. ইত্যাদি।
UNICEF, UNHCR, ILO, UNESCO, CEADAW ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানসমূহ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। এছাড়াও যুক্তরাজ্যের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্রের হিউমান রাইট ওয়াচ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ রচনা
মানবাধিকার ও উন্নয়নঃ
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৮৬ সালে গৃহীত এক প্রস্তাবে উন্নয়নকে মানবাধিকারের আওতাভূক্ত করে নেয়। প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন ও মানবাধিকার এ দুটি ধারণা পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মূলত উন্নয়নকে জাতিসংঘ মানবাধিকার হিসেবে গ্রহণ করেছে। তবে উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে কিনা তার জন্য প্রয়োজন হবে-
i) মৌলিক জীবনধারণের অধিকার (Condition of life) যেমন-খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, অবসর ও বিনোদন প্রভৃতি সুযোগ ভোগ করার নিশ্চয়তা রয়েছে কিনা।
ii) Condition of Work অর্থাৎ চাকরি, আয় ইত্যাদির অধিকার আছে কিনা।
iii) Equality of Access of resources অর্থাৎ ভূমি, পুঁজি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকার ভোগ করছে কিনা।
iv) Participation বা স্থানীয়, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত কিনা।
এসবের হিসেবে UNDP, Human Development Index প্রকাশ করেছে এবং আয়ুষ্কাল, বয়স, শিক্ষা, আয় প্রভৃতি বিষয়গুলোকে উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
মানবাধিকারের সুফলঃ
সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পর অসংখ্য উদ্যোগ এবং কর্মকৌশল গ্রহণ করা হয়েছে যা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার পর বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটেছে। জনসাধারণের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার অনেকাংশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শিক্ষার গুরুত্বকে বিবেচনা করে ১৯৯৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মানবাধিকার শিক্ষা দশক হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল।
প্রতিবন্ধকতাঃ
মানবাধিকার সমগ্র বিশ্বে অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। তবুও এর কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। মূলত বিশ্বে এখনো মানবাধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিশ্বের এক বিরাট জনগোষ্ঠী মানবাধিকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এখন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বের জনগণের ক্ষুধা নিবারণের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেনি। এখনো বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি অনেক দেশে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি পুরোপুরি সুফল বয়ে আনতে পারেনি।
মানবাধিকার ও বাংলাদেশঃ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ জন্মলগ্নের পরপরই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জনঅধিকারকে সংবিধানে স্থান দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়িই অর্থাৎ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হয়েছে। ১০ই ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদার সাথে এখানে পালিত হয় মানবাধিকার দিবস। তবে মানবাধিকার পুরোপুরি রক্ষিত হয়নি-এ দেশে। বাংলাদেশ মানবাধিকার সমন্বয় পরিষদের ভাষ্যমতে ১৯৯৬ সালের নয় মাসে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়েছে। পুলিশ ও জেলহাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, সড়ক ও নৌদুর্ঘটনা, যৌতুকপ্রথা, খুন-রাহাজানি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা, সন্ত্রাস এখন বাংলাদেশের অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এসবই মানবাধিকার লংঘনের কারণ। সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজি আমাদের সাধারণ মানুষগুলোর জীবনকে বিপন্ন করে দিয়েছে। আবার নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক দলীয় কোন্দল, হত্যা, গুম। এমতাবস্থায় এদেশে মানবাধিকার চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, বিশৃঙ্খলামুক্ত সমাজ গঠন না করা গেলে, মানবাধিকার এখানে শুধু কথাতেই থেকে যাবে, কার্যে তা প্রকাশ পাবে না।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও সংস্থাসমূহের ভূমিকাঃ
আশার কথা হলো বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার রক্ষায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা অন্যতম। সংবিধানে ২৬-৪৭ অনুচ্ছেদে মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতকরণের স্বীকৃতি রয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন NGO মানকবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। ৮০’র দশক থেকেই বেসরকারিভাবে তারা কার্যক্রম শুরু করেছে এদেশে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামঃ
এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্নীতির থাবা। সামরিকতন্ত্র, ভোটারবিহীন ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ, কালো টাকার দৌরাত্ম, রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতির মধ্যেও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সরকারি পর্যায়ে প্রাণান্ত চেষ্টা চলছে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও সুজন, আইন ও সালিস কেন্দ্র প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায়। সরকারিভাবে মানবাধিকার রক্ষায় ১ সেপ্টেম্বর ২০০৮ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করেছে বাংলাদেশ সরকার।
উপসংহারঃ
গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধকে ধারণ করে পরস্পরের প্রতি সহযোগিতা, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্ব নিয়েই দেশ ও বিশ্বে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত মানুষগুলোর চোখের পানি মুছে দিয়ে তাদের অধিকারকে যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য মানবাধিকার সংরক্ষণ একান্তভাবে জরুরি। তাহলেই সমগ্র বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হবে শান্তি, সম্প্রীতি, এগিয়ে যাবে দেশ, এগিয়ে যাবে পৃথিবী আর মানব সভ্যতা।