বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক রচনা- সংকেত: ভূমিকা; জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষক; জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা; খাদ্য উৎপাদনে কৃষি ও কৃষক; পুষ্টি সমস্যা সমাধানে কৃষি ও কৃষক; শিল্পায়নে কৃষি ও কৃষকের অবদান; রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের অবদান; কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা; বাংলাদেশের কৃষক; কৃষকের অতীত অবস্থা; কৃষকের বর্তমান অবস্থা; কৃষি ও কৃষকের সমস্যা; কৃষি খাত এবং কৃষকের উন্নয়নের জন্য করণীয়; উপসংহার।
বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষক রচনা
ভূমিকা:
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ কৃষির উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করছে এবং প্রায় ৬০ ভাগ কর্মসংস্থানের উৎস হলো কৃষি। আমরা যে শিল্প খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি, সেই শিল্পের কাঁচামালও আসে কৃষি খাত থেকে। দেশের মানুষের খাদ্য উৎপাদনসহ, শিল্প উন্নয়ন ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও কৃষির ভূমিকাই প্রধান। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে কৃষি ও কৃষকের উন্নতির উপরই দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে।
জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষক:
যেহেতু আমাদের অর্থনীতির মূল অবকাঠামো কৃষির উপর দন্ডায়মান, সে কারণেই জাতীয় অর্থনীতিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা অপরিমেয়। কৃষি উৎপাদন কম হলে যে শুধু খাদ্য ঘাটতি দেখা দেবে তাই নয়, সেই সাথে যেসব শিল্প, কৃষিভিত্তিক কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল সেসব শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যহত হব। একই সাথে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি হবে আকাশচুম্বী। কৃষি উৎপাদন ব্যহত হলে অভ্যন্তরীণ ও বর্হিবাণিজ্য থামকে দাঁড়ায়। অপরদিকে কৃষি উৎপাদন ভালো হলেই দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠে। তাই এ ক্ষেত্রে কৃষকের ভূমিকাই মূখ্য।
জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা:
যে দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর দাঁড়িয়ে আছে, সে দেশের জাতীয় আয়ে কৃষির ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে শিল্পের কাঁচামাল থেকে শুরু করে খাদ্য দ্রব্যসহ প্রায় সকল উৎপাদিত দ্রব্যের উৎসই হলো কৃষি। দেশের কৃষিজাত বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে এবং দেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
খাদ্য উৎপাদনে কৃষি ও কৃষক:
বাঙালির খাদ্য তালিকায় অপরিহার্য খাবার ভাত, ডাল, মাছ, শাক-সব্জি, ফল ইত্যাদি সবই কৃষকের চাষাবাদের ফসল। বাংলাদেশের ২.২০ কোটি চাষযোগ্য জমির প্রায় ৯০ ভাগ জমিতেই উৎপাদিত হয় খাদ্য শস্য। এ দেশের ৭০ ভাগ জমি ব্যবহৃত হয় ধান উৎপাদনের জন্য। কিন্তু নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগে এদেশে ফসল নষ্ট হয়। তাছাড়া জনসংখ্যার বিপরীতে চাষযোগ্য জমি কম হওয়ায় এবং বিজ্ঞানভিত্তিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় আমরা এখনও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। তবুও ৮০ ভাগ খাদ্য আমাদের কৃষকই যোগান দেয়।
পৃষ্টি সমস্যা সমাধানে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা:
পুষ্টিহীনতা আমাদের দেশের একটি অন্যতম সমস্যা। গ্রামের জনসংখ্যার অধিকাংশই অপুষ্টিতে ভুগছে। শতকরা ৭০ জন মহিলা রক্তশূন্যতায় ভুগছে, প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যাচ্ছে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাবে। ৪-১৪ বছরের ৭৪ শতাংশ ছেলে এবং ৭৫ শতাংশ মেয়ে রক্তশূন্যতায় ভুগছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের ১৬টি জেলার ১২ লাখ লোক অপুষ্টির করণে গলগন্ড রোগে আক্রান্ত। কৃষক নানা রকম পুষ্টিকর শাকসবজি ও ফল উৎপাদন করে এই পুষ্টিহীনতা দূরীকরণে অবদান রাখছে।
শিল্পায়নে কৃষি ও কৃষকের অবদান:
শিল্পায়নেও কৃষির অবদান অবর্ণনীয়। বাংলাদেশের প্রধান শিল্প বস্ত্রশিল্প। এই শিল্পের মূল কাঁচামাল কৃষি থেকেই আসে। অপরদিকে চিনি শিল্পের মূল কাঁচামাল আখও কৃষি থেকেই আসছে। কৃষকের হাতে উৎপাদিত হচ্ছে গম, যা থেকে তৈরি হচ্ছে উৎকৃষ্ট মানের আটা, ময়দা ইত্যাদি। এভাবেই বাংলাদেশের ছোট বড় প্রায় প্রতিটি শিল্পই কৃষিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে।
রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে কৃষি ও কৃষকের অবদান:
বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের একটি বড় অংশ আসে কৃষি খাত থেকে। সোনালি আঁশের কথা আমরা সকলেই জানি, যা রপ্তানি করে আমাদের দেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। এই সোনালি আঁশ তথা পাট কৃষকেরই উৎপাদিত পণ্য। বর্তমানে পাটজাত নানা দ্রব্য যেমন, থলে, বস্তা প্রভৃতি রপ্তানি হচ্ছে। পাটের পরেই রয়েছে চায়ের স্থান। প্রতিবছর বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে চা রপ্তানি করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। তবে বর্তমানে কিছুটা হ্রাস পেলেও এক সময় কৃষিখাত থেকে এদেশের ৭০/৭৫ ভাগ রপ্তানি আয় আসত।
আরও পড়ুনঃ রচনা
কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কৃষি ও কৃষকের ভূমিকা:
বেকার সমস্যা বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা। কৃষি ক্ষেত্রে কাজের জন্য শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, ফলে প্রচুর লোক এখান থেকেই জীবিকা নির্বাহ করতে পারছে। আবার কৃষিজাত কাঁচামাল থেকে হচ্ছে শিল্প প্রতিষ্ঠান। সে সব প্রতিষ্ঠানেও প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন। এভাবে সৃষ্টি হচ্ছে অনেক লোকের কর্মসংস্থান।
বাংলাদেশের কৃষক: ‘ভোর না হতেই লাঙ্গল কাধে, মাঠ পানে কে যায়?
সে আমাদের গাঁয়ের কৃষক, বাস আমাদের গায়।’
বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এমনই কৃষকের বাস। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই, প্রতিটি কৃষক লাঙ্গল কাধে নিয়ে মাঠ পানে ছুটতে থাকে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে সে ফসল ফলায়। ভোরবেলা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলতে থাকে তার এই পরিশ্রম। এভাবেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রতিটি কৃষক আমাদেরই জন্য উৎপাদন করে যাচ্ছে খাদ্য শস্য ও অন্যান্য কৃষিজাত দ্রব্য।
কৃষকের অতীত অবস্থা:
বাংলাদেশের কৃষকের অতীত অবস্থা আমরা ইতিহাস, লোককথা, প্রবাদ-প্রবচনের মধ্য দিয়েই বুঝতে পারি। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনায় বাংলাদেশের কৃষকদের কথা স্থান পেয়েছে। এদেশের কৃষকের এক সময় ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। সেই সাথে কৃষাণীর পরনে থাকত তাঁতের শাড়ী আর নানা রকম অলংকার।
কৃষকের বর্তমান অবস্থা:
অতীতে বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ছিল কম, সেই তুলনায় চাষযোগ্য জমি ছিল বেশি, সাথে ছিল উর্বর জমি, সেই কারণে ফসল ফলত অধিক। কিন্তু বর্তমানে এদেশে আর সেই অবস্থা নেই। এখন দরিদ্র, শিক্ষাহীন, অসহায় কৃষক তার কষ্টের ন্যায্য মূল্য আর পায় না। তবে বর্তমানের কৃষকরা মান্ধাতার আমলের কুপমন্ডকতা ও কুসংস্কার থেকে বেরিয়েছে। তাই তার নিজেদের উন্নয়নের চেষ্টা করে চলেছে অবিরাম।
কৃষি ও কৃষকের সমস্যা:
বাংলাদেশের কৃষিখাত নানা সমস্যায় জর্জরিত, যার ভুক্তভোগী হচ্ছে এদেশের কৃষকরা। এসব সমস্যা অতিক্রম করে কৃষি কাজ চালিয়ে যেতে তাদের অনেক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। নিম্নে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকদের কিছু প্রধান সমস্যা তুলে ধরা হলো।
মূলধনের অভাব:
বর্তমানে দেশের অধিকাংশ কৃষকই গরীব ফলে তারা প্রায়ই কাজ করতে গিয়ে মূলধন সংকটে পড়ছেন। ফলে সঠিক সময়ে মূলধনের অভাবে সঠিক কাজটি না করতে পেরে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
প্রশিক্ষণের অভাব:
কৃষিতে ফলন বাড়ানোর জন্য দক্ষ কৃষকের বিকল্প নেই। আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষকই অশিক্ষিত এবং অদক্ষ। এমনকি তাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও নেই।
কৃষি উপকরণের অভাব:
এদেশের কৃষকরা এখনও পুরাতন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির অভাবে অনেক পিছিয়ে যাচ্ছেন।
সেচ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা:
শুকনো মৌসুমে কৃষকরা ইরি ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সেচ দিতে পারেন না। ফলে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর আমাদের দেশের অনেক ফসল নষ্ট হয় এতে ক্ষতিগ্রস্ত হন কৃষকরা।
ত্রুটিপূর্ণ বাজার:
আমাদের দেশের কৃষিজাত দ্রব্যের বাজার ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।
সংরক্ষণ ব্যবস্থার ত্রুটি:
আমাদের দেশে উদ্বৃত্ত ফসল সংরক্ষণের সুব্যবস্থা অপ্রতুল হওয়ার কারণে প্রতিবছরই অনেক ফসল নষ্ট হয়ে কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ছে।
কৃষি খাত এবং কৃষকের উন্নয়নের জন্য করণীয়:
বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়ন এবং কৃষকদের অবস্থার উন্নতির জন্য নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। যেমন-
– কৃষকদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
– বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করার জন্য কৃষকদের হাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও কীটনাশক পৌঁছে দিতে হবে।
– ভূমিহীন কৃষকদের জন্য ভূমির ব্যবস্থা করতে হবে।
– সেচ কাজের জন্য প্রয়োজনীয় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হবে।
– কৃষকদেরকে স্বল্প সুদে ঋণদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– বাজার ব্যবস্থায় ত্রুটিপূর্ণ বিষয়গুলোর সংস্কার করতে হবে।
– কৃষিজাত দ্রব্য সঠিকভাবে সংরক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে।
উপসংহার:
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অপরিসীম ভূমিকা রাখছে অথচ এদেশের কৃষকের অবস্থা এখনও নাজুক। তাদের সামাজিক মর্যাদা নেই বললেই চলে। এই জন্য শিক্ষিত নাগরিকের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন। যে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী শহরে বসে কৃষকের ভাগ্য নির্ধারণ করেন তাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নই দেশের উন্নয়ন। কৃষি ও কৃষকদের উন্নয়নে গৃহীত সময়োচিত পদক্ষেপই জাতীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তাই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।