নৌকা ভ্রমণ রচনা সংকেত: ভূমিকা; ভ্রমণের পথসমূহ, ভ্রমণের পরিকল্পনা; যাত্রার পূর্বপ্রস্তুতি; যাত্রা শুরু; যাত্রা পথের বর্ণনা; প্রাকৃতিক দৃশ্য; গাঁয়ের হাট; নৌকায় দুপুরের খাবার; নদীতে সূর্য অস্ত; রাতের দৃশ্য; গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো এবং বাড়ি অভিমুখে যাত্রা; উপসংহার।

রচনা

নৌকা ভ্রমণ রচনা

ভূমিকাঃ

ভ্রমণ সবসময়ই আনন্দদায়ক। তবে ভ্রমণ শুধু আনন্দই দেয় না বরং ভ্রমণের মাধ্যমে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে বিচিত্র সব তথ্য জানা যায়। মানবমন একই সঙ্গে আনন্দ ও জ্ঞানপিপাসু। পৃথিবীতে এমন কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া দুস্কর যে ভ্রমণে যেতে পছন্দ করে না। সেক্ষেত্রে নানারকম ভ্রমণের মধ্যে বিশেষভাবে আনন্দদায়ক হচ্ছে নৌকাভ্রমণ। কেননা নৌকাভ্রমণের মাধ্যমে মানুষ খুব সহজেই প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারে।

ভ্রমণের পথসমূহঃ

সাধারণত স্থলপথ, জলপথ ও আকাশপথে ভ্রমণ করা যায়। নদীমাতৃক দেশ আমাদের এ বাংলাদেশ। এ দেশের বিস্তীর্ণ মাটির বুকে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল। এদেশের মানুষ একসময় নৌপথেই বেশি যাতায়াত করতো। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বর্তমানে নৌপথ ততো বেশি ব্যবহৃত না হলেও গ্রাম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে নৌকাতেই ভ্রমণ করতে হয়। এমনি এক ভ্রমণের সুযোগ হয়েছিল আমারও।

ভ্রমণের পরিকল্পনাঃ

বার্ষিক পরীক্ষা শেষে আমার স্কুল তখন বন্ধ। বন্ধুরা মিলে কোথাও বেড়াতে যাবার পরিকল্পনা করছিলাম। কিন্তু কোনো পরিকল্পনাতেই সবাই একমত হতে পারছিলাম না। হঠাৎ একজন বলে উঠলো নৌকা ভ্রমণের কথা। যেহেতু আমরা বন্ধুরা সকলেই শহরে বড় হয়েছি, কখনো নৌকা ভ্রমণের সুযোগ আসেনি তাই আমরা সবাই একবাক্যে নৌকা ভ্রমণে যেতে রাজি হয়ে গেলাম। দিন-তারিখ নির্ধারণ করা হলো। আগামী শুক্রবার আমরা গৌমতী নদীতে নৌকা ভ্রমণে যাব।

আরও পড়ুনঃ রচনা

যাত্রার পূর্বপ্রস্তুতিঃ

যাত্রার আগের দিন একটি মাঝারি আকারের নৌকা ভাড়া করা হলো। নৌকায় দুজন মাঝি নেওয়া হলো। যাত্রাপথে সাথে নিলাম ক্যামেরা, টেপরেকর্ডার, পানি এবং কিছু শুকনো খাবার বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, কলা ইত্যাদি। একটা বড় ফ্ল্যাক্সে চাও নেওয়া হলো।

যাত্রা শুরুঃ

সকাল ৮টায় আমরা দ্বেবীদ্বার ঘাটে এসে পৌঁছলাম। কিন্তু সময়টা ছিল শীতকাল ফলে চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা ছিল। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম কুয়াশা কিছুটা কাটলে তবেই আমরা যাত্রা শুরু করব। কুয়াশা কেটে রোদ উঠতে উঠতে সকাল ১০টা বেজে গেল। রোদ ওঠার পর আমরা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়ে নৌকায় উঠে পড়লাম। সাথে সাথে মাঝি নোঙর তুলে, নৌকা ছাড়লো। আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম।

যাত্রা পথের বর্ণনাঃ

নৌকা ছাড়ার কিছু পরেই মাঝি গান ধরলো “মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে আমি আর বাইতে পারলাম না।’’ নৌকায় ওঠার পর যদিও আমাদের একটু একটু ভয় লাগছিলো কিন্তু মাঝির এমন মনোমুগ্ধকর গানের সুরে আমাদের ভয় পুরোপুরি কেটে গেলো। বৈঠা ও পানির মিলিত ছন্দ আর সেই সাথে মাঝির গাওয়া গান আমাদের মনে এক অভূতপূর্ব দোলা দিয়ে গেল। আমরা নৌকার গলুইয়ে মুগ্ধ হয়ে বসে মাঝির গান শুনছিলাম। এরই মধ্যে স্রোতের টানে নৌকা কখন যে মাঝনদীতে এসে পড়েছে আমরা টেরই পেলাম না। ততক্ষণে অন্য মাঝিও সুর ধরেছে। দুজনে মনের সুখে মাঝে মাঝে ভাটির গান ধরেছে-

“আরে ও রঙিলা নায়ের মাঝি

তুমি এই ঘাটে লাগায়ারে নাও

নিগুম কথা কইয়া যাও শুনি।”

নদীতে আরো অসংখ্য নৌকা চলছিল। কোনোটি যাত্রীবাহী, কোনোটি আবার মালবাহী। ছোট-বড় মাঝারি নানা আকারের নৌকা। মাঝির কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম আকার-আকৃতি অনুযায়ী এসব নৌকার আলাদা আলাদা নামও আছে। ডিঙি, সাম্পান, পানসি, ময়ুরপঙ্খী আরো কত নাম। কিছু কিছু নৌকা আবার ইঞ্জিনে চলে।

আরও পড়ুনঃ Paragraph

প্রাকৃতিক দৃশ্যঃ

মাঝনদীতে এসে অনুভব করলাম সৃষ্টিকর্তা কত অপরূপ করে আমাদের এই দেশকে তৈরি করেছেন। আমরা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে নদীর দু’ধারের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। নদীর দু’ধারে ফসলের ক্ষেত, খোলা মাঠ, মাঝে মাঝে দু’একটা ঘর। আমাদের নৌকা কখনো মাঝনদী, আবার কখনো তীর ঘেষে এগিয়ে চলল। হঠাৎ দেখলাম এক ঝাঁক সাদা বক উড়ে যাচ্ছে। দু’পাশের সবুজ প্রকৃতির মধ্যে সাদা বকগুলো যেন চারপাশের প্রকৃতিকে আরো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছে। কোনো কোনো নৌকা থেকে মাছ ধরা হচ্ছে। জালের মধ্যে আটকে থাকা মাছের রূপালি শরীরে রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কোথাও কোথাও ছেলে-মেয়ে দল নদীতে হৈ-চৈ করে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। গাঁয়ের বধূঁরা এসেছে নদীর ঘাটে পানি নিতে। নৌকা যখন মাঝনদীতে তখন দূরের গাছপালা আর ঘরবাড়িগুলোকে মনে হচ্ছে কোনো শিল্পীর নিপুন হাতের চিত্রকর্ম। চারিদিক শান্ত, নিশ্চুপ। কেবল পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমরা যেন কথাবলাও ভুলে গেছি। মনে হচ্ছে কথা বলতে গেলেই অপরূপ সুন্দর এই প্রকৃতির কোনো একটি দৃশ্য হারিয়ে যাবে। এরই ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু দৃশ্য আমরা ক্যামেরাবন্দি করলাম।

গাঁয়ের হাটঃ

দেখতে দেখতে কখন যে মধ্য দুপুর পেরিয়ে গেছে তা আমরা টেরই পেলাম না। মাঝিরা যখন একটা ঘাটে এসে নৌকা বাঁধল তখন আমাদের সময়ের কথা মনে হলো। যে ঘাটে আমাদের নৌকা বাঁধা হয়েছে তার পাশেই গ্রামের হাঁট বসেছে। আমরা সবাই মিলে ছোট কিন্তু কোলাহলপূর্ণ হাটে মহানন্দে ঘুরে বেড়ালাম। ছোট হাটটিতে বলতে গেলে সবই পাওয়া যায়। মাটির হাঁড়ি, খেলনা, পুতুল এসব যেমন আছে তেমনি চাল, ডাল, মুড়ি, মুড়কি, মাছ-মাংসও আছে। একপাশে ছোট এক দোকানে দেখলাম জিলাপী ভাজছে ময়রা। আরো আছে রঙিন কাচের চুড়ি, আলতার দোকান। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে আমরা নৌকায় ফিরে এলাম।

নৌকায় দুপুরের খাবারঃ

ফিরে এসে দেখলাম একজন মাঝি নৌকাতেই বানানো মাটির চুলায় ভাত রান্না করছে। আর অন্যজন মাছ কুঁটছে। খেতে বসে টের পেলাম আমাদের সবার পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে। নৌকায় বসে গরম ভাত আর নদীর টাটকা মাছের ঝোল খেতে অমৃতের মতো লাগলো। চেটেপুটে খাওয়া শেষ করে নৌকার ছইয়ের নিচে সবাই একটু জিরিয়ে নিয়ে, রোদ একটু পড়ে এলেই আবার যাত্রা শুরু করলাম। এবার বাড়ি ফেরার পালা।

নদীর সূর্য অস্তঃ

দুপুরের খাবার একটু দেরিতে খাওযায় খুব তাড়াতাড়ি যেন বিকেল হয়ে গেল। শীতের বিকেলে নদীর ঠান্ডা বাতাসে একটু একটু শীত লাগছিল। কিন্তু তবু বিকেলের শান্ত নদীর অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চললাম। যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিলো ততোই নদীর নিস্তব্ধতা ভেঙে পাখিরা কলকালিতে মেতে উঠলো। সূর্যটাও যেন দিন শেষে ক্লান্ত হয়ে ধীরে ধীরে পশ্চিমাকাশে হেলে পড়তে লাগলো। আস্তে আস্তে পশ্চিমের আকাশ সূর্যের রক্তিম আভায় লাল হয়ে উঠলো। আরো কিছুক্ষণ পর সূর্যি মামা যেন নদীর পানিতেই ডুব দিলেন। আমরা সবাই নৌকা বসে সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করলাম। আমার জীবনে এই প্রথম আমি নদীতে সূর্য অস্ত যাবার দৃশ্যটি দেখলাম, যা আমার স্মৃতিতে চির অমলিন হয়ে থাকবে।

রাতের দৃশ্যঃ

সেদিন ছিল পূর্ণিমা রাত। সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পরেই পূর্বাকাশে চাঁদ মামা উঁকি দিলেন। সন্ধ্যা গাঢ় হওয়ার পর চাঁদ তার অপূর্ব জ্যোৎস্নালোকিত রূপ নিয়ে হাজির হলেন। নদীর বুকে জ্যোৎস্নার দৃশ্য যে কতখানি মনোমুগ্ধকর তা স্বচক্ষে না দেখলে বোঝা যায় না। আমরা এই প্রথম এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে আশ্চর্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জ্যোৎস্নালোকে নদীর দু’ধারে গাছপালা আর বাড়িঘরের দৃশ্যকে অপার্থিব মনে হচ্ছিল। সন্ধ্যার পরে নদীতে নৌকা চলাচল করছিল। এর মধ্যে বেশিরভাগই মাছ ধরার নৌকা। জেলেদের নৌকাগুলোতে কুপির টিমটিমে আলোগুলোকে মনে হচ্ছিল যেন মিটমিট করে তারা জ্বলছে। রাতের আঁধারে পাখির কলকাকলি থেমে গিয়ে নদী আবার শান্ত-নিশ্চুপ হয়ে গেছে। চারিদিকের নীরবতার মধ্যে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এক অদ্ভূত সুরের মূর্ছনা সৃষ্টি করেছিলো।

গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো এবং বাড়ি অভিমুখে যাত্রাঃ

স্রোতের সাথে নেচে নেচে আমাদের নৌকা কখন যে ঘাটে এসে পড়েছে আমাদের কোনো খেয়াল ছিল না। মাঝিদের ডাকে আমাদের হুঁশ হলো। আমরা পুনরায় দেবীদ্বার ঘাটে এসে নামলাম আর সেখান থেকে যে যার যার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। কিন্তু আমাদের সবারই মন পড়ে রইল মাঝ নদীতে। বাসায় পৌঁছাতে রাত প্রায় ১০টা বেজে গিয়েছিলো।

উপসংহারঃ

ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সবসময়ই আনন্দের। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নৌকা ভ্রমণ বিচিত্র কিছু না হলেও এ ভ্রমণ আমাদের সবার মনেই চির অম্লান হয়ে আছে।

Google News