দারিদ্র্য বিমোচন রচনা- সংকেত: ভূমিকা; দারিদ্র্যের ধারণা; বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি; দারিদ্র্যের কারণ; দারিদ্র্র্যের প্রভাব; দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী; সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ; বেসরকারি পদক্ষেপ; বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে করণীয়; উপসংহার।
দারিদ্র্য বিমোচন রচনা
ভূমিকা:
আধুনিক বিশ্বে মানুষ যখন মহাকাশ জয়ের নেশায় মত্ত, সেই সময় নানাবিধ সমস্যা মানব সমাজকে অস্থির করে তুলছে। দারিদ্র্য সমস্যা তেমনই একটি সমস্যা। যার নির্মম কষাঘাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন আজ বিপর্যস্ত। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশসমূহে এই সমস্যা প্রকট। বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এবং দারিদ্র্যপীড়িত একটি দেশ। জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি ও অগ্রগতির ধারাকে ব্যহত করছে এই সমস্যা। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী সবচেয়ে আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম।
দারিদ্র্যের ধারণা:
দারিদ্র্য একটি আপেক্ষিক বিষয়। একে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে দারিদ্র্যের প্রকৃতি ও সূচক বিভিন্ন হয়ে থাকে। আভিধানিক অর্থে ‘দারিদ্র্য’ মানে অভাব, অনটন বা অপর্যাপ্ততা। অর্থাৎ দারিদ্র্য বলতে এমন অবস্থাকে বুঝায় যেখানে মানুষ ন্যূনতম মান বজায় রেখে মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। আর্থিক সামর্থ্যরে অভাবে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসার মতো আবশ্যকীয় ব্যয় নির্বাহ করতে সমর্থ হয় না। সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে দারিদ্র্যের প্রকৃতিকে দুটি দিক থেকে মাপা হয়। দৈনিক মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণ ও আয় দিয়ে এ দুটি সূচক তৈরি হয়। খাদ্য গ্রহণের সূচকে যারা প্রতিদিন ২১২২ কিলোক্যালরির কম খাবার গ্রহণ করে তারা দারিদ্র্য সীমার নীচে অবস্থান করে। আর যারা ১৮০৫ কিলোক্যালরির কম খাবার পায় তারা চরম দারিদ্র্যের শিকার। অন্যদিকে মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বিশ্বব্যাংকের প্রদত্ত দারিদ্র্যের সীমা হলো দৈনিক ২ ডলার। অর্থাৎ যারা দৈনিক ন্যূনতম ২ ডলার আয় করতে পারে না তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আর যাদের আয় দৈনিক মাথাপিছু ১.২৫ ডলারের কম, তারা চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করে।
বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি:
স্বাধীনতা অর্জনের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা ছিল চরম দারিদ্র্য। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। এ সময় থেকে সরকারের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকা- আবর্তিত হতে থাকে দারিদ্র্য বিমোচনকে প্রাধান্য দিয়ে। বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (PRSP) দারিদ্র্য বিমোচনে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হলেও বাংলাদেশের বর্তমান দারিদ্র্য পরিস্থিতি সন্তোষজনক নয়। বিভিন্ন তথ্যমতে দারিদ্র্যের নিম্নসীমায় বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা হার ক্রমহ্রাসমান হলেও মোট দরিদ্র জনসংখ্যা পরিমাণ কমেনি, বরং বেড়েছে। ২০১৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে চরম দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যার শতকরা হার ১৫ ভাগ, যা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ছিল ৩১.৫% ভাগ। বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
দারিদ্র্যের কারণ:
দারিদ্র্য একটি ব্যাপক সামাজিক সমস্যা এবং এর পেছনে একক কোনো কারণ দায়ী নয়। বহুবিধ কারণে এদেশে দারিদ্র্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। দীর্ঘদিনের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ, অনুন্নত অবকাঠামো, অনুন্নত কৃষি ব্যবস্থা, অনগ্রসর শিল্প, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা, অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদের অসম বণ্টন, নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা, বেকারত্ব ও বাণিজ্য ঘাটতি, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব, বাস্তবমুখী নীতি ও পরিকল্পনার অভাব, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং নেতৃত্বের অদক্ষতা, সমাজের প্রতিটি স্তরে ব্যাপক আকারে দুর্নীতি ইত্যাদি বাংলাদেশের দারিদ্র্যের প্রধান কারণ।
দারিদ্র্যের প্রভাব:
দারিদ্র্য এমন একটি সমস্যা, যার প্রভাব প্রতীয়মান হয় সমাজের প্রতিটি স্তরে। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিকেই দারিদ্র্যের ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখা যায়। দারিদ্র্যের কারণে মানুষ মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারে না। যথাযথ সুযোগ-সুবিধার অভাবে মানব সম্পদে পরিণত হতে পারে না। তাদের জীবনযাত্রার মানও নিম্নমুখী হয়। দারিদ্র্যের কারণে সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, সামাজিক সমস্যা যেমন-দাম্পত্য কলহ, যৌতুক প্রথা, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা, পারিবারিক ভাঙন ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং দুর্নীতির অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, যার জন্য দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এটি কেবল একটি সমস্যা নয়, বরং বহুবিধ সমস্যার জন্মদাতাও বটে।
দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচী:
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার, বেসরকারি সংস্থা (NGO) এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসমূহ কাজ করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এসব কর্মসূচীকে প্রধানত সরকারি এবং বেসরকারি এ দুই ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ:
বাংলাদেশ সরকার দারিদ্র্য বিমোচন এবং মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার এ পর্যন্ত ৬ টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং PRSP-I ও II বাস্তবায়ন করেছে এবং করছে। সবগুলো পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন এবং জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন। সরকার এজন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
শিক্ষা উন্নয়ন:
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়তে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো শিক্ষা। এজন্য সরকার সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করেছে। গরীব শিক্ষার্থীদের জন্য ‘স্কুল ফিডিং’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য, শিক্ষার বিনিময়ে টাকা, ছাত্রী উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ ইত্যাদির পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে শক্তিশালী এবং স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়।
কৃষি উন্নয়ন:
কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তি। এজন্য সরকার কৃষি উন্নয়নে উন্নত বীজ, সার, সেচ এবং কৃষিঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, যা দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে।
আরও পড়ুনঃ রচনা
শিল্পোন্নয়ন:
শিল্পের উন্নয়ন ছাড়া বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না। এটি আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এজন্য সরকার শিল্পের উন্নয়নে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঊচত স্থাপনসহ দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তাদেরকে শিল্প স্থাপনে সরকার সহায়তা দিয়ে আসছে, যা দারিদ্র্য বিমোচন এবং উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছে।
বয়স্কভাতা কর্মসূচী:
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যারা আয়-উপার্জন করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন, তাদেরকে ভাতা দেওয়ার কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।
এসিড দগ্ধ মহিলা ও প্রতিবন্ধী কল্যাণ:
এসিড দগ্ধ মহিলা ও অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ কর্মসূচির অধীনে মাসিক ৩০০ টাকা হারে ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা ভাতা: বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলা, যারা সমাজে অবহেলিত, সরকার তাদের ভাতার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
মাতৃত্বকালীন ভাতা: গরিব পরিবারের গর্ভবর্তী মা যেন অপুষ্টিতে না ভোগেন, সেজন্য সরকার ভাতার ব্যবস্থা করেছে। যেটি মা ও শিশু স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও টাকা (কাবিখা/কাবিটা) কর্মসূচী: গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন এবং মঙ্গাপীড়িত অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার প্রথমে কাবিখা প্রকল্প গ্রহণ করে। পরবর্তীতে এটি কাবিটাতে রূপান্তরিত করা হয়।
গৃহায়ণ তহবিল: গ্রামীণ ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের গৃহনির্মাণে সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার এই তহবিল গঠন করেছে।
অন্যান্য: উপরে উল্লিখিত কর্মসূচী ছাড়াও সরকার সরাসরি দারিদ্র্য বিমোচনের সাথে সম্পর্কযুক্ত কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে আদর্শ গ্রাম, সমন্বিত মৎস্য কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন, পশু সম্পদ উন্নয়ন, গ্রামীণ মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প, পল্লী বিদ্যুতায়ন প্রকল্প, যুব প্রশিক্ষণ ও আত্মকর্মসংস্থান প্রকল্প, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প ইত্যাদি।
বেসরকারি পদক্ষেপ: বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এর মধ্যে প্রধান হলো গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকা, আশা, কারিতাস, স্বনির্ভর বাংলাদেশ, RDRS প্রভৃতি। এ সকল এনজিওর কার্যক্রমের মধ্যে প্রধান হলো ক্ষুদ্রঋণ বিতরণ, স্বাস্থ্য সেবা, কৃষি উন্নয়ন, কুটির শিল্প স্থাপন, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা, রেশম উন্নয়ন, নলকূপ ও স্যানিট্রেশন, সামাজিক বনায়ন, গৃহায়ন ইত্যাদি।
বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনে করণীয়:
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সুসংগঠিত পরিকল্পিত, পর্যাপ্ত এবং বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। দারিদ্র্য বিমোচনে প্রত্যাশিত সাফল্য অর্জনের জন্য নিচের বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন-
– সম্পদের বৈষম্য হ্রাসে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে।
– শিল্প ও কৃষিতে উন্নয়ন ঘটাতে হবে।
– দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
– আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসন করতে হবে।
– দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
– আইনের শাসন, সুবিচার, সুশাসন ও রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে।
– অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করতে হবে।
– পর্যাপ্ত ঋণ সুবিধার নিশ্চয়তা থাকতে হবে এবং তা সহজলভ্য করতে হবে।
– সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI) আকর্ষণ করার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
– সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার:
বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের এক সমস্যা হলো দারিদ্র্য। দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বাংলাদেশের প্রচেষ্টাও প্রশংসনীয়। কিন্তু তার পরও এই সমস্যার প্রত্যাশিত সাফল্য আসছে না। যে কারণে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক হাজারো সমস্যা আঁকড়ে ধরে আছে আমাদের এই দেশটাকে। তাই দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশের দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব।