কম্পিউটার রচনা- সংকেত: ভূমিকা; কম্পিউটার কী; কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস; কম্পিউটার ও তার কর্মপদ্ধতি; কম্পিউটারের ব্যবহার; বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার; তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার; বেকারত্ব ও কম্পিউটার; কম্পিউটার জনিত নানা সমস্যা; কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা; উপসংহার।
কম্পিউটার রচনা
ভূমিকা:
যুগে যুগে বিজ্ঞান মানুষের হাতে তুলে দিয়েছে অভাবনীয় সব আবিষ্কার। এইসব আবিষ্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে ক্রমে সহজ থেকে সহজতর করে তুলেছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং কার্যক্ষমতাসম্পন্ন আবিষ্কার হলো কম্পিউটার। বিংশ শতাব্দীতে আবিষ্কৃত এ যন্ত্রটিকে যন্ত্রমস্তিষ্ক বলাটা অনেকাংশেই সঙ্গত। বহুমুখী ও বিচত্র কর্মদক্ষতার অধিকারী, দ্রুতগতিসম্পন্ন এই যন্ত্রটি সময়ের অপচয় নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি মানুষের কার্যক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতেও সহায়ক। শক্তিশালী এ যন্ত্রটির ব্যবহার অপেক্ষাকৃত সহজ, ফলে এটি অতি দ্রুত মানবজীবনের একটি অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে।
কম্পিউটার কী:
আধুনিক কম্পিউটার হলো এমন একটি যন্ত্র যা অসংখ্য তথ্য (Data) গ্রহণ ও ধারণ করতে পারে এবং সুনির্দিষ্ট নির্দেশ অনুসরণ করে উপাত্তগুলোকে গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ এবং যুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায় কাজে লাগাতে পারে; সেই সাথে প্রোগ্রাম ঠিক করে দিলে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ করতে পারে। Computer শব্দটি গ্রিক শব্দ compute থেকে এসেছে। আক্ষরিক অর্থে compute শব্দটির মানে হলো হিসাব বা গণনা করা। সে ক্ষেত্রে computer শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। তবে বর্তমানে কম্পিউটারকে শুধুমাত্র গণনাকারী যন্ত্র বলা যায় না। আধুনিক কম্পিউটার একই সাথে তথ্য-উপাত্ত গ্রহণ, গণনা, বিশ্লেষণসহ সকল ধরণের কাজ করতে পারে।
কম্পিউটার আবিষ্কারের ইতিহাস:
আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের পেছনে রয়েছে অসংখ্য উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন মানুষের বহু বছরের নিরলস পরিশ্রম এবং গবেষণা। প্রাচীন মানুষেরা গণনার কাজে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করে থাকলেও প্রথম গণনাযন্ত্র হিসেবে অ্যাবাকাস (Abacus) নামক একটি যন্ত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ফরাসি বিজ্ঞানী “ব্লেইজ প্যাসকেল” (Basic Pascal) ১৬৪২ সালে সর্বপ্রথম যান্ত্রিক ক্যালকুলেটর আবিষ্কার করেন। অনেক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে চার্লস ব্যাবেজ এমন একটি গণনাযন্ত্র আবিষ্কার করেন যেটি কেবলমাত্র যান্ত্রিকভাবে, মানুষের সহায়তা ছাড়াই গাণিতিক হিসাব করতে পারে। ব্যাবেজ এই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন ডিফারেন্স ইঞ্জিন। এই যন্ত্র নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি আরও উন্নত ও সার্বজনীন একটি যন্ত্রের ধারণা লাভ করেন। যদিও প্রয়োজনীয় যন্ত্রের অভাবে ব্যাবেজ তার গবেষণালব্ধ ধারণাটিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে যেতে পারেননি। তবে তাঁর পরিকল্পিত গণনাযন্ত্রটিই পরবর্তীকালে আধুনিক কম্পিউটারের ধারণা দিয়েছে। মূলত আধুনিক কম্পিউটারের সূত্রপাত ঘটেছে ১৮৩৩ সালে।
আরও পড়ুনঃ Paragraph
কম্পিউটার ও তার কর্মপদ্ধতি:
কম্পিউটার তার কর্মপদ্ধতি পরিচালনা করে মূলত তিনটি অংশের মাধ্যমে। এগুলো হলো- ইনপুট, সেন্ট্রাল প্রসেসিং ইউনিট বা সিপিইউ এবং আউটপুট। ইনপুট অংশের কাজ হলো তথ্য-উপাত্ত (Data) এবং নির্দেশন গ্রহণ করা। স্রেন্টাল প্রসেসিং ইউনিট তথা সিপিইউ হলো কম্পিউটারের মস্তিষ্ক। কেননা এই অংশ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকে। মূলত সিপিইউ গৃহীত ডাটার ওপর বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে এবং ডাটা ও ফলাফল সংরক্ষণ করে। সর্বোপরি, আউটপুট ফলাফল প্রকাশের কাজটি করে। এই তিনটি অংশের নিয়ন্ত্রণকারী কাঠামোটিকে একত্রে বলা হয় হার্ডওয়্যার।
মূলত কম্পিউটারের বাহ্যিক সকল যন্ত্রপাতি অর্থাৎ মনিটর, কী বোর্ড, মাউস, হার্ড-ডিস্ক, মাদারবোর্ড, স্ক্যানার, ডিস্ক, প্রিন্টার, স্পিকার প্রভৃতি যন্ত্রসমূহ হার্ডওয়্যার এর অন্তর্গত। অন্যদিকে, যে সমস্ত প্রোগ্রাম সমষ্টি হার্ডওয়্যারকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কার্যক্ষম করে সেগুলোকে বলা হয় সফটওয়্যার। মূলত সমস্যা সমাধান বা কার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ধারাবাহিকভাবে সাজানো নির্দেশমালাকে একত্রে প্রোগ্রাম বলা হয়। আর হার্ডওয়্যারকে পরিচালনাকারী প্রোগ্রাম সমষ্টিই হলো সফটওয়্যার। কম্পিউটারের বিস্ময়কর কার্যক্ষমতার মূলে রয়েছে এসকল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশের সমষ্টিবদ্ধ সহায়তা।
কম্পিউটারের ব্যবহার:
বর্তমানে দৈনন্দিন জীবনে কম্পিউটারের ব্যবহার এত ব্যাপক যে খুব সহজেই একে কম্পিউটারের যুগ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। আধুনিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কম্পিউটারের উপস্থিতি লক্ষ করার মতো। প্রকৃতপক্ষে এমন কোনো কাজই নেই যা কম্পিউটার করছে না। কম্পিউটার কোটি কোটি সংখ্যার জটিল হিসাব কয়েক মুহূর্তে সমাধান করছে। ব্যাংক, বীমা, কিংবা বড় বড় কলকারখানা পরিচালনার পরিকল্পনা, নির্দেশনা, আয়-ব্যয়, লাভ-ক্ষতির সমস্ত হিসাব-নিকাশ হচ্ছে কম্পিউটারের সহায়তায়। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থায়, গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রেও পাঠ্যবইয়ের সহায়ক তথ্য প্রদান থেকে শুরু করে পরীক্ষার ফল প্রকাশ পর্যন্ত যাবতীয় কার্য সম্পাদনে রয়েছে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহার।
চিকিৎসা ক্ষেত্রে একদিকে কম্পিউটার রোগ নির্ণয় এবং রোগীর শারীরিক অবস্থা নিরূপণ করছে। অন্যদিকে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও সহায়তা করছে। কম্পিউটার ছবি আঁকছে, পুরনো ছবি সম্পাদনা করছে, মানচিত্র আঁকছে, প্রিন্টিং ও গ্রাফিক্স ডিজাইন এবং বাড়ি-ঘর, গাড়ি, বিমান, ভাস্কর্য প্রভৃতির নকশা তৈরি করছে। বিনোদনের ক্ষেত্রেও কম্পিউটারের জুড়ি মেলা ভার। ঘরে বসেই ক্রিকেট, ফুটবল, রেসিং, দাবাসহ নানারকম ভিডিও গেমস্ খেলা যায় কম্পিউটারে। যে সমস্ত দুরূহ কাজ মানুষের অসাধ্য, যে সব দুর্গম এলাকায় মানুষ যেতে অক্ষম কম্পিউটার সেখানেও পৌঁছে যাচ্ছে এবং কার্য সমাধা করছে সুনিপুণভাবে। উদাহরণস্বরূপ, কম্পিউটার চালিত ‘স্ক্যানার’ আটলান্টিক মহাসাগরের অতল থেকে খুঁজে এনেছিল বিধ্বস্ত বিমানের অংশ।
মুদ্রণ শিল্পেও কম্পিউটার এক এবং অদ্বিতীয় ভূমিকা পালন করছে। কম্পিউটারে ইন্টারনেটের সাহায্যে ঘরে বসেই বিশ্বের যেকোনো তথ্য জানা সম্ভব। এছাড়া তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রেও কম্পিউটার সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। কম্পিউটারের এমন বহুবিধ ব্যবহারের কারণে আধুনিক জীবনের সঙ্গে এর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আধুনিক জীবনের একটি দিনও তাই কম্পিউটার ছাড়া কল্পনাও করা যায় না। বহুবিধ কার্যক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার মানব সভ্যতাকে দিয়েছে বিপুল কর্মসুবিধা, দুরন্ত গতি এবং সর্বোপরি অযুত সম্ভাবনা।
বাংলাদেশে কম্পিউটারের ব্যবহার:
১৯৬৪ সালে সর্বপ্রথম বাংলাদেশে পরমাণু শক্তি কমিশনে কম্পিউটার নিয়ে আসা হয়। ১৯৮৪ সাল থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটারের ব্যবহার চালু হয়েছে। বর্তমানে দেশে ব্যাপকভাবে কম্পিউটারের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত তরুণ সমাজকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচেতন করে তুলতে সরকার উদ্যোগী হয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করার ফলে দিনে দিনে এর ব্যবহার বেড়েই চলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে কম্পিউটার এবং এর সংশ্লিষ্ট ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি।
আরও পড়ুনঃ রচনা
তথ্যপ্রযুক্তি ও কম্পিউটার:
তথ্যপ্রযুক্তির সাথে কম্পিউটার নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। বিগত দুই দশকে গোটা বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর সাফল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমেই ঘটেছে বিশ্বায়নের মতো ঘটনা যা গোটা বিশ্বকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। মূলত তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ ও প্রকাশের সঙ্গে জড়িত ব্যবস্থাটিই তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তি বা ICT নামে পরিচিত। আর এই তথ্য প্রযুক্তি পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় কম্পিউটার, বিশেষত ইন্টারনেট। তথ্য-প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার-এ দুয়ের যুগল সাহচর্যে মানব সভ্যতার আমূল পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।
বেকার সমস্যা সমাধান ও কম্পিউটার:
মানব সৃষ্ট এই যন্ত্রটি কখনো কখনো মানুষেরই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।, যার মধ্যে বেকারত্ব উল্লেখযোগ্য। একটি কম্পিউটার মুহূর্তের মধ্যে কয়েকজন মানুষের কাজ করছে। ফলে স্বভাবতই আগে যেখানে চার-পাঁচ জন লোক কাজ করত, কম্পিউটারের কারণে সেখানে একটি লোকই যথেষ্ট। তবে বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই কম্পিউটার নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছে। দিন দিন ব্যাপক হারে কম্পিউটারের প্রসার ঘটে চলেছে। এখানে প্রচুর দক্ষ জনবল প্রয়োজন হচ্ছে। অর্থাৎ কম্পিউটারের পরিকল্পনানুযায়ী সঠিক ব্যবহার বেকারত্ব হ্রাস করে মানুষের জন্য নিত্যনতুন কাজের ক্ষেত্রও তৈরি করছে। এতে শিক্ষিত তরুণদের ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে।
কম্পিউটারজনিত বিভিন্ন সমস্যা:
সব বিষয়েরই ভালো-মন্দ দুটি দিক আছে। তেমনি আধুনিক মানুষ একদিকে যেমন কম্পিউটারের আশীর্বাদপুষ্ট, অন্যদিকে বিভিন্ন সমস্যায় পীড়িত। কম্পিউটারের সহায়তায় কিছু অপরাধ চক্র অস্ত্র নির্মাণের মাধ্যমে বিশ্বে বিশৃঙ্খলতা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট। এছাড়া যুদ্ধ-বিগ্রহ, দেশ দখল, সাইবার ক্রাইম প্রভৃতি নিন্দনীয় কাজে কম্পিউটারকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ইন্টারনেট যদিও তরুণ সমাজের সামনে উন্মুক্ত করেছে জ্ঞানের অবারিত প্রান্তর তবুও নানারকম কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল সংস্কৃতির প্রচার যুবসমাজকে ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের পথে। ভিডিও গেমসহ নানারকম খেলা অনেক সময় মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে ফেলে। কম্পিউটার থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এছাড়া বেশিক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহার চোখের জন্য ক্ষতিকর।
কম্পিউটার শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা:
আধুনিক সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে কম্পিউটার শিক্ষা অপরিহার্য। কম্পিউটারের সঠিক এবং ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে কম্পিউটার সম্পর্কিত জ্ঞান অপরিহার্য। মানুষ যতবেশি কম্পিউটার সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করবে, কম্পিউটারের অপব্যবহার ততো কমে আসবে। আর কম্পিউটারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলেই দেশ ও জাতির অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
উপসংহার:
আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে কম্পিউটারকে বাদ দিয়ে চলা অসম্ভব। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কম্পিউটার ব্যবহার আজ অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেক্ষেত্রে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে বিবেচনা করেই কম্পিউটারের প্রয়োগ ক্ষেত্র নির্বাচন করতে হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কম্পিউটারের পরিকল্পিত ব্যবহার পারে আধুনিক সভ্যতা ও উন্নতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে।