নিরক্ষরতা দূরীকরণ রচনা- সংকেত: ভূমিকা; নিরক্ষরতা কী; বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার; নিরক্ষরতার স্বরূপ; নিরক্ষরতার কারণ; নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান; নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায়; ছাত্র সমাজের ভূমিকা; সরকারি উদ্যোগ; বেসরকারি প্রচেষ্টা; উপসংহার।

রচনা

নিরক্ষরতা দূরীকরণ রচনা

ভূমিকা:

নিরক্ষরতা একটি অভিশাপ। শিক্ষাই আলো, অন্যদিকে নিরক্ষরতা অন্ধকার। সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের যেমন অগ্রগতি সাধিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এই প্রতিবন্ধকার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিরক্ষরতা। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। শিক্ষা মানুষকে সত্যিকার মানুষ রূপে গড়ে তুলতে পারে। অন্যদিকে নিরক্ষরতা মানুষের জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলে। শিক্ষা এমন একটি ধারা যার মাধ্যমে মানুষ নিজেকে জানতে পারে, অপরকে বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারে। তাই সমাজ থেকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অপরিহার্য।

নিরক্ষরতা কী:

অক্ষর জ্ঞানের অভাবকে নিরক্ষরতা বলা হয়। অর্থাৎ যারা অক্ষর চেনে না তাদেরকে নিরক্ষর বলা হয়। বিদ্যাহীন বা অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষ চোখ থাকতেও অন্ধ। শিক্ষা মানুষের জ্ঞানের গভীরতা বাড়ায়, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। আর নিরক্ষরতা মানুষকে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের দিকে ধাবিত করে ফলে বিশ্ব জ্ঞান ভান্ডারের সাথে তার কোনো সম্পর্ক থাকে না।

বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার:

বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার বিশাল আকার ধারণ করেছে। ফলে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী বাংলাদেশের নিরক্ষরতার হার ৪২.১ ভাগ। যা মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক।UNESCO, Education for all Global Monitoring Report ২০১৩/১৪ অনুযায়ী বিশ্বের মোট প্রাপ্ত বয়স্ক নিরক্ষর ব্যক্তির তিন চতুর্থাংশ বাস করে বাংলাদেশসহ ১০টি উন্নয়নশীল দেশে। | Millenium Development Goals (MDG) পূরণের ৮টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন’। এর লক্ষ্যে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার শতভাগ উন্নীত করা এবং প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার শূন্যে নামিয়ে আনা।

আরও পড়ুনঃ Paragraph

নিরক্ষরতার স্বরূপ:

নিরক্ষরতা জাতীয় জীবনে এক বিশাল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘের ১৯৫০ সালের জরিপের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ৪৪% মানুষ নিরক্ষর। ১৯৯৮ সালের ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের নিরক্ষরতার হার ২১%। সর্বোচ্চ নিরক্ষরতার হার অনুন্নত বা দরিদ্র দেশগুলোতে যেমন এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশ। সর্বনিম্ন নিরক্ষরতার হার উন্নত দেশগুলোতে। যেমন- অস্ট্রেলিয়া, জাপান, রাশিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে। শিক্ষার হার বেশি হওয়ার কারণে এই সকল দেশের মানুষ সচেতন। তারা দক্ষ এবং কারিগরি জ্ঞানে সমৃদ্ধ। যা দেশের অগ্রগতির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

নিরক্ষরতার কারণ:

বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র দেশ, এই ক্ষুদ্র দেশে নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান। নিরক্ষরতা তার মধ্যে অন্যতম। নিম্নে বাংলাদেশে নিরক্ষরতার বিভিন্ন কারণসমূহ তুলে ধরা হলো-

– অর্থনৈতিক দৈন্যদশা, হীনমন্যতা, উচ্চাকাক্সক্ষার অভাব বাংলাদেশের নিরক্ষরতার অন্যতম কারণ।

– ধর্মীয় গোঁড়ামির ফলে এদেশে অনেক শিশু ধর্মীয় শিক্ষা ব্যতিত আধুনিক যুগোপযোগী শিক্ষা হতে বঞ্চিত।

– অনেক দরিদ্র কৃষক পড়াশুনার পরিবর্তে তাদের ছেলেমেয়েদের কৃষিকাজে নিয়োজিত করে।

– বাংলাদেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চল রয়েছে যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়নি। যার ফলে দেশের একটি বিরাট অংশ নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে।

– অধিক জনসংখ্যার ফলে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক শিশুর শিক্ষার সঠিক ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে বিপুল পরিমাণ শিশু নিরক্ষর থাকে।

– অনেক অশিক্ষিত বাবা মা তাদের সন্তানদের পড়াতে চান না বলে সন্তানেরা নিরক্ষর থেকে যায়।

– সর্বোপরি শিক্ষার সরঞ্জামের অভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, সরকারের প্রত্যক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের ফলে দেশের একটি বিরাট অংশ নিরক্ষর থেকে যাচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ রচনা

নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান:

নিরক্ষরতা একটি জাতিকে অচল করে দিতে পার। নিরক্ষরতার হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করার লক্ষ্যে সবার জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে সামাজিক জীবনে নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে। এ জন্যই প্লেটো বলেছেন- ‘অজ্ঞতা সব দুর্ভাগ্যের মূলস্বরূপ।’ তাই নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার মাধ্যমে শিক্ষিত সমাজ গড়ে তুলতে হবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। তারা নিরক্ষর বহু শিশুকে শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় এনেছে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণের উপায়:

নিরক্ষরতার করাল গ্রাস থেকে জাতিকে রক্ষা করার জন্য তা দূরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিম্নে নিরক্ষরতা দূরীকরণের বিভিন্ন উপায়সমূহ তুলে ধরা হলোঃ

– সর্বজনীন শিক্ষা: দেশের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বস্তরে পৌঁছানোর জন্য সর্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষিত ও ছাত্র সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।

– জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: জনসংখ্যা বাংলাদেশে একটি বিশাল সমস্যা। ফলে বিপুল পরিমাণ শিশুর শিক্ষা ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। তাই পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

– শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন: বাংলাদেশে অনেক অঞ্চল রয়েছে যেখান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই। তাই সেই সকল অঞ্চলে নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ব্যবস্থা নিতে হবে।

– দারিদ্র্য দূরীকরণ: দারিদ্র দূরীকরণ ছাড়া ব্যাপক শিক্ষা বিস্তার সম্ভব না। এজন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা, সরকারি বিভিন্ন ভাতা প্রদান করা, শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি চালু প্রভৃতি ব্যবস্থা নিতে হবে।

– নারী শিক্ষার প্রসার: নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য এম.এ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

– নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন: দারিদ্র্যতার জন্য অনেক ছেলেমেয়ে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত থাকে। ফলে শিক্ষার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়। তাই এসব গরীব ছেলেমেয়েদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

– সাক্ষরতা অভিযান: আমাদের দেশে অনেক ছাত্র-ছাত্রী যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করছে। তারা প্রত্যেকেই যদি প্রত্যেকের অঞ্চলে বা এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে সাক্ষরতা অভিযান চালায় তবে নিরক্ষরতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

ছাত্র সমাজের ভূমিকা:

বর্তমানে বাংলাদেশে নিরক্ষরতার যে অবস্থা তা দিয়ে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই সুন্দর সুশৃঙ্খল সমাজ গড়ার লক্ষ্যে ছাত্রদের এগিয়ে আসতে হবে। যুগে যুগে তরুণ ছাত্র সমাজই আশার আলো দেখিয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন- ‘সকলের মধ্যে ঘৃণিত ব্যক্তি সে, যে নিজে শিক্ষিত হয়ে অপরকে শেখায় না।’ তাই ছাত্রদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে এগিয়ে আসতে হবে।’

সরকারি উদ্যোগ:

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে সরকার নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। এ লক্ষ্যে সরকার ১৯৯০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী সংসদে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাস করে। সম্প্রতি ২০১৪ সালে সরকার প্রথমবারের মতো প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্য এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। যা সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়া সরকার Digital Bangladesh Vision 2021-বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালের মধ্যে নিরক্ষর মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

বেসরকারি উদ্যোগ:

সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা বা এনজিও সাক্ষরতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। যেমন- ব্র্যাক, আশা, কেয়ার, গ্রামীণ ব্যাংক প্রভৃতি সংস্থা। নিরক্ষরতা দূরীকরণ কেবলমাত্র সরকারের দায়িত্ব নয়। সরকারি প্রচেষ্টার পাশাপাশি বেসরকারি প্রচেষ্টা যুক্ত হলে খুব দ্রুত নিরক্ষরতা দূর করা সম্ভব হবে।

উপসংহার:

নিরক্ষরতা মানবজীবনে উন্নতির পথে প্রধান বাধা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিরক্ষরতা দূরীকরণে অনেকটাই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। তাই স্বাধীন দেশের মর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসাবে নিজেদের গৌরব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরক্ষরতা দূরীকরণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

Google News